হাইড্রোজেন জ্বালানি হলো এমন একটি শক্তির উৎস, যেখানে হাইড্রোজেন গ্যাস (H₂) জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি ফুয়েল সেল বা দহনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বা তাপ উৎপন্ন করে, যার একমাত্র উপজাত পানি। হাইড্রোজেন মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রচুর উপাদান, তবে এটি সাধারণত পানি বা হাইড্রোকার্বনে যৌগ হিসেবে থাকে। এটি পরিবেশবান্ধব এবং জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে বিবেচিত। হাইড্রোজেন জ্বালানি পরিবহন, শিল্প, এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
হাইড্রোজেন উৎপাদনের প্রধান পদ্ধতিগুলো হলো ইলেক্ট্রোলাইসিস, স্টিম-মিথেন রিফর্মিং, এবং থার্মোকেমিক্যাল প্রক্রিয়া। ইলেক্ট্রোলাইসিসে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে পানিকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে বিভক্ত করা হয়। সবুজ হাইড্রোজেন নবায়নযোগ্য শক্তি (যেমন সৌর, বায়ু) দিয়ে ইলেক্ট্রোলাইসিসের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়, যা কার্বন-মুক্ত। স্টিম-মিথেন রিফর্মিং প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করে, তবে এটি কার্বন নির্গত করে। নীল হাইড্রোজেনে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে, বিশ্বের ৯৫% হাইড্রোজেন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন হয়, তবে সবুজ হাইড্রোজেনের দিকে ঝোঁক বাড়ছে।
হাইড্রোজেন জ্বালানি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবহনে, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল গাড়ি, বাস, ট্রেন, এবং এমনকি বিমানে ব্যবহৃত হয়। টয়োটা মিরাই এবং হিউন্ডাই নেক্সো জনপ্রিয় ফুয়েল সেল গাড়ি। শিল্পে, হাইড্রোজেন ইস্পাত উৎপাদন, রাসায়নিক শিল্প, এবং তেল শোধনাগারে ব্যবহৃত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে, হাইড্রোজেন গ্যাস টারবাইন বা ফুয়েল সেলের মাধ্যমে শক্তি সরবরাহ করে। বাংলাদেশে, হাইড্রোজেন পরিবহন ও কৃষিতে সার উৎপাদনে ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি দূরবর্তী এলাকায় শক্তি সরবরাহেও কার্যকর হতে পারে।
হাইড্রোজেন জ্বালানি পরিবেশবান্ধব, কারণ এর দহনে কার্বন নির্গত হয় না। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় উচ্চ শক্তি দক্ষতা প্রদান করে। ফুয়েল সেল প্রযুক্তি নিরব এবং কম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন। হাইড্রোজেন সংরক্ষণ ও পরিবহন করা যায়, যা শক্তি সঞ্চয়ের সমস্যা সমাধান করে। সবুজ হাইড্রোজেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে, হাইড্রোজেন কার্বন নির্গমন কমিয়ে টেকসই শক্তি সরবরাহ করতে পারে। এটি অর্থনৈতিকভাবে জ্বালানি আমদানি নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে।
হাইড্রোজেন জ্বালানির পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন ব্যয়বহুল, কারণ ইলেক্ট্রোলাইসিসে প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন। হাইড্রোজেন সংরক্ষণ ও পরিবহন জটিল, কারণ এটি অত্যন্ত দাহ্য এবং কম ঘনত্বের। ফুয়েল সেল প্রযুক্তি এখনও ব্যয়বহুল এবং ব্যাপকভাবে উপলব্ধ নয়। অবকাঠামো, যেমন হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন, সীমিত। বাংলাদেশে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, অর্থায়ন, এবং নীতিগত কাঠামোর অভাব চ্যালেঞ্জ। তবে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং গবেষণা এই বাধা দূর করতে পারে।
Picture: istockphoto.com
বাংলাদেশে হাইড্রোজেন জ্বালানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল, বিশেষ করে সবুজ শক্তির প্রেক্ষাপটে। দেশে সৌরশক্তি এবং বায়ুশক্তির সম্ভাবনা রয়েছে, যা সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। হাইড্রোজেন পরিবহন খাতে, যেমন বাস ও ট্রাক, এবং শিল্পে, যেমন সার উৎপাদনে, ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যেমন BUET এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাইড্রোজেন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করতে পারে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং জলবায়ু পরিকল্পনা এই প্রযুক্তির প্রচারে সহায়ক। তবে, প্রাথমিক বিনিয়োগ, দক্ষতা উন্নয়ন, এবং নীতিগত সমর্থন প্রয়োজন।
বাংলা কল্পবিজ্ঞানে শক্তির ভবিষ্যৎ এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির কল্পনা করা হয়েছে। জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর “নিরুদ্দেশের কাহিনী” গল্পে বিজ্ঞান ও প্রকৃতির সমন্বয় তুলে ধরেছেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে উন্নত শক্তি প্রযুক্তি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নিয়ে আলোচনা রয়েছে। আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানে, হাইড্রোজেনের মতো পরিচ্ছন্ন শক্তির ব্যবহার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব চিত্রিত হয়। এই গল্পগুলো টেকসই শক্তির প্রতি সচেতনতা বাড়ায় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।
বিশ্বব্যাপী হাইড্রোজেন জ্বালানি গ্রহণে উৎসাহ বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো লক্ষ্যে সবুজ হাইড্রোজেনে বিনিয়োগ করছে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া হাইড্রোজেন-ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলছে। চীন হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল যানবাহনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভারত জাতীয় হাইড্রোজেন মিশন চালু করেছে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (IEA) অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে সবুজ হাইড্রোজেনের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রযুক্তি ও অর্থায়ন পেতে পারে।
হাইড্রোজেন জ্বালানি নৈতিক ও সামাজিক প্রশ্ন তুলে ধরে। সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদনে পানি ব্যবহার স্থানীয় পানি সংকট সৃষ্টি করতে পারে। শিল্পে হাইড্রোজেন গ্রহণে জীবাশ্ম জ্বালানি শ্রমিকদের চাকরি হ্রাসের ঝুঁকি রয়েছে। হাইড্রোজেন প্রযুক্তি কি উন্নয়নশীল দেশের জন্য সাশ্রয়ী হবে? বাংলাদেশে, হাইড্রোজেন প্রকল্পে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সচেতনতা ও শিক্ষা এই প্রশ্নগুলোর সমাধানে সহায়ক হবে।
হাইড্রোজেন জ্বালানি শক্তির ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ। সবুজ হাইড্রোজেনের ব্যয় হ্রাস, উন্নত সংরক্ষণ প্রযুক্তি, এবং অবকাঠামো সম্প্রসারণ এটিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করবে। হাইড্রোজেন মহাকাশ যান এবং দূরবর্তী গ্রহে শক্তি সরবরাহে ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলাদেশে, হাইড্রোজেন কৃষি, শল্পন, এবং পরিবহনে টেকসই শক্তি সমাধান দেবে। তরুণদের প্রশিক্ষণ এবং গবেষণায় বিনিয়োগী এই বাংল্দেশকে এই দৌড়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। হাইড্রোজেন শক্তির নতুন দিগন্ত, যা পরিচ্ছন্ন এবং টেকসই ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতি দেয়।
হাইড্রোজেন জ্বালানি শক্তির ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এটি পরিবেশবান্ধব, বহুমুখী, এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ। তবে, ব্যয়, অবকাঠামো, এবং প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ দূর করতে হবে। বাংলাদেশে হাইড্রোজেন গ্রহণে নীতি, গবেষণা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলা কল্পবিজ্ঞান শক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখায়। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে হাইড্রোজেন জ্বালানি পৃথিবী ও বাংল্দেশের জন্য টেকসই শক্তির পথ প্রশস্ত করবে।