এই নিবন্ধে আমরা মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানের অসাধারণ অবদান নিয়ে আলোচনা করব। বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে ব্ল্যাক হোল, ডার্ক ম্যাটার এবং বহির্জাগতিক জীবনের সম্ভাবনা পর্যন্ত, এই লেখায় বিজ্ঞানের বিস্ময় ও বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হলো বিগ ব্যাং। প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি অতি ক্ষুদ্র, অতি ঘন এবং অতি উত্তপ্ত বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। এই তত্ত্বটি প্রথম প্রস্তাব করেন বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জ লেমেত্রে। পরবর্তীতে, কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের আবিষ্কার এই তত্ত্বের পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ সরবরাহ করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিগ ব্যাংয়ের পর মহাবিশ্ব দ্রুত প্রসারিত হতে শুরু করে, যা আজও চলমান।
মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং তত্ত্বের চিত্র, যেখানে একটি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের প্রসারণ দেখানো হয়েছে। সংগৃহিত: ছবি
মহাবিশ্বের প্রায় ২৭% অংশ ডার্ক ম্যাটার এবং ৬৮% ডার্ক এনার্জি দ্বারা গঠিত, যা আমরা সরাসরি দেখতে বা পরিমাপ করতে পারি না। ডার্ক ম্যাটার মহাকর্ষের মাধ্যমে ছায়াপথ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু এটি আলো নির্গত বা শোষণ করে না। অন্যদিকে, ডার্ক এনার্জি মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণের জন্য দায়ী। এই দুটি রহস্যময় উপাদান বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও একটি ধাঁধা।
ডার্ক ম্যাটারের প্রভাবে ছায়াপথের গঠন, যেখানে অদৃশ্য ভরের প্রভাব দেখানো হয়েছে। সংগৃহিত: ছবি
ব্ল্যাক হোল হলো মহাবিশ্বের এমন একটি অঞ্চল, যেখানে মহাকর্ষ এতটাই শক্তিশালী যে আলোও এর থেকে পালাতে পারে না। আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের ধারণা প্রথম প্রস্তাবিত হয়। ২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ প্রথমবারের মতো একটি ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়, যা বিজ্ঞান জগতে একটি মাইলফলক। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে, সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে ব্ল্যাক হোলের মতো ধারণাগুলি কল্পনার সঙ্গে মিশে গেছে।
ডার্ক ম্যাটারের প্রভাবে ছায়াপথের গঠন, যেখানে অদৃশ্য ভরের প্রভাব দেখানো হয়েছে। সংগৃহিত: ছবি
মহাবিশ্বে কি শুধু পৃথিবীতেই জীবন আছে? এই প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের মনে শতাব্দী ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। SETI (Search for Extraterrestrial Intelligence) প্রকল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বহির্জাগতিক সভ্যতার সংকেত খুঁজছেন। মঙ্গল গ্রহে জলের অস্তিত্ব এবং ইউরোপা (বৃহস্পতির চাঁদ) তরল জলের সমুদ্রের সম্ভাবনা জীবনের অস্তিত্বের আশা জাগিয়েছে। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে, জগদানন্দ রায়ের "শুক্র ভ্রমণ" গল্পে ভিনগ্রহী প্রাণীর কল্পনা করা হয়েছে, যা বিজ্ঞান ও কল্পনার এক অনন্য মিশ্রণ।
মঙ্গল গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণার একটি চিত্র। সংগৃহিত: ছবি
বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। জগদীশচন্দ্র বসুকে বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর "নিরুদ্দেশের কাহিনী" (১৮৯৬) আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের গল্প নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা কল্পবিজ্ঞান। পরবর্তীতে, সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজ বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। বেগম রোকেয়ার "সুলতানার স্বপ্ন" নারীবাদী কল্পবিজ্ঞানের একটি অগ্রণী উদাহরণ। এই ঐতিহ্য আজও কল্পবিশ্বের মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা এখনও মহাবিশ্বের অনেক রহস্য উন্মোচনের পথে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্ট্রিং তত্ত্ব এবং মাল্টিভার্সের ধারণা বিজ্ঞানীদের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও এই ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা কম্পিউটার সায়েন্স ও পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। ভবিষ্যতে, আরও উন্নত টেলিস্কোপ এবং স্পেস মিশন আমাদের মহাবিশ্বের বোঝাপড়াকে আরও গভীর করবে।
মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞান আমাদের চিন্তাভাবনার সীমা প্রসারিত করেছে। বিগ ব্যাং থেকে ব্ল্যাক হোল, ডার্ক ম্যাটার থেকে এলিয়েন জীবনের সম্ভাবনা—প্রতিটি আবিষ্কার আমাদের বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়। বাংলা কল্পবিজ্ঞান এই বিস্ময়কে সাহিত্যের মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানের এই যাত্রা আমাদের শেখায় যে, কৌতূহল এবং কল্পনা মানবজাতির সবচেয়ে বড় শক্তি।