এই নিবন্ধে ব্ল্যাক হোলের রহস্যময় জগৎ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর গঠন, বৈশিষ্ট্য, বিজ্ঞানে এর গুরুত্ব এবং বাংলা কল্পবিজ্ঞানে এর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকে হকিং রেডিয়েশন পর্যন্ত, ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের গোপন দরজা হিসেবে আমাদের বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়
ব্ল্যাক হোল হলো মহাবিশ্বের এমন একটি অঞ্চল, যেখানে মহাকর্ষ এতটাই শক্তিশালী যে কিছুই, এমনকি আলোও, এর কবল থেকে পালাতে পারে না। এ কারণে এটি "কালো" বা অদৃশ্য। ব্ল্যাক হোলের ধারণা প্রথম প্রস্তাবিত হয় আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মাধ্যমে, যা ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়। তবে, "ব্ল্যাক হোল" শব্দটি ১৯৬৭ সালে জন হুইলার প্রথম ব্যবহার করেন। ব্ল্যাক হোলকে প্রায়ই মহাবিশ্বের গোপন দরজা হিসেবে কল্পনা করা হয়, কারণ এটি সময় ও স্থানের ধারণাকে বিকৃত করে।
ব্ল্যাক হোলের কল্পিত চিত্র, যেখানে আলো ও পদার্থ এর মধ্যে টানা হচ্ছে। সংগৃহিত: ছবি
ব্ল্যাক হোল সাধারণত একটি বৃহৎ নক্ষত্রের জীবনচক্রের শেষে গঠিত হয়। যখন একটি নক্ষত্র তার জ্বালানি (হাইড্রোজেন) শেষ করে ফেলে, তখন এটি সংকুচিত হতে শুরু করে। যদি নক্ষত্রটির ভর সূর্যের তুলনায় ৩ গুণের বেশি হয়, তবে এটি একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোল হয়ে যায়। এছাড়াও, ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলি গঠিত হয় গ্যাস এবং নক্ষত্রের বিশাল সমষ্টির সংকোচনের মাধ্যমে।
সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোল গঠনের চিত্র। সংগৃহিত: ছবি
ইভেন্ট হরাইজন হলো ব্ল্যাক হোলের একটি কাল্পনিক সীমানা, যার পরে কিছুই পালাতে পারে না। এটিকে "নো রিটার্ন" পয়েন্ট বলা হয়। ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরে সময় ও স্থান এমনভাবে বিকৃত হয় যে আমাদের সাধারণ বোঝাপড়া ব্যর্থ হয়। ২০১৯ সালে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (EHT) প্রথমবারের মতো মেসিয়ার ৮৭ ছায়াপথের কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলে বিশ্বকে বিস্মিত করে।
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দ্বারা গৃহীত প্রথম ব্ল্যাক হোলের ছবি। সংগৃহিত: ছবি
ব্ল্যাক হোল সম্পূর্ণ কালো নয়—এই ধারণাটি প্রস্তাব করেন স্টিফেন হকিং। তিনি দেখান যে, কোয়ান্টাম প্রভাবের কারণে ব্ল্যাক হোল থেকে কণা নির্গত হতে পারে, যা হকিং রেডিয়েশন নামে পরিচিত। এই বিকিরণের ফলে ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে তার ভর হারায় এবং শেষ পর্যন্ত বাষ্পীভূত হয়ে যেতে পারে। এই তত্ত্ব ব্ল্যাক হোলের জীবনচক্র সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে মহাকর্ষের সমন্বয়ের পথ দেখায়।
হকিং রেডিয়েশনের কল্পিত চিত্র, যেখানে ব্ল্যাক হোল থেকে কণা নির্গত হচ্ছে। সংগৃহিত: ছবি
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, ব্ল্যাক হোল সময় ও স্থানকে এমনভাবে বিকৃত করে যে এটি একটি "সিঙ্গুলারিটি" তৈরি করে—একটি বিন্দু যেখানে ঘনত্ব অসীম হয়। এই সিঙ্গুলারিটি মহাবিশ্বের নিয়মকে ভেঙে দেয়। কিছু তত্ত্ব অনুসারে, ব্ল্যাক হোল হয়তো অন্য মহাবিশ্বের দরজা হতে পারে, যদিও এটি এখনও কল্পনার পর্যায়ে রয়েছে। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে, সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে এই ধরনের ধারণা কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
ব্ল্যাক হোলের কাছে সময়-স্থানের বিকৃতির কল্পিত চিত্র। সংগৃহিত: ছবি
বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে, এবং ব্ল্যাক হোল এতে একটি জনপ্রিয় বিষয়। জগদীশচন্দ্র বসু, যিনি বাংলা কল্পবিজ্ঞানের পথিকৃৎ, তাঁর "নিরুদ্দেশের কাহিনী" গল্পে বিজ্ঞানের বিস্ময় তুলে ধরেছেন। সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে ব্ল্যাক হোলের মতো ধারণাগুলি কল্পনার সঙ্গে মিশে একটি রোমাঞ্চকর রূপ নিয়েছে। আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানেও ব্ল্যাক হোলের রহস্য জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
ব্ল্যাক হোল শুধু রহস্যময় নয়, এটি মহাবিশ্বের গঠন বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছায়াপথের কেন্দ্রে মহাকর্ষীয় ভূমিকা পালন করে এবং নক্ষত্র গঠনকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও, ব্ল্যাক হোলের অধ্যয়ন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান এবং মহাকর্ষের মধ্যে সমন্বয় স্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে, আরও উন্নত টেলিস্কোপ এবং প্রযুক্তি ব্ল্যাক হোলের আরও গভীর রহস্য উন্মোচন করবে।
ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ভবিষ্যতে, লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি (LIGO) এবং অন্যান্য প্রকল্প ব্ল্যাক হোলের সংঘর্ষ এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিয়ে আরও তথ্য সরবরাহ করবে। এছাড়াও, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্বের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের সিঙ্গুলারিটির রহস্য উন্মোচিত হতে পারে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরাও এই ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন, বিশেষ করে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে।
ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের একটি গোপন দরজা, যা আমাদের বিজ্ঞান ও কল্পনার সীমানা প্রসারিত করে। আইনস্টাইনের তত্ত্ব থেকে হকিংয়ের বিকিরণ, এবং বাংলা কল্পবিজ্ঞানের কল্পনা থেকে আধুনিক গবেষণা পর্যন্ত, ব্ল্যাক হোল আমাদের বিস্ময়ে ভরিয়ে দেয়। এটি শুধু মহাবিশ্বের রহস্য নয়, আমাদের নিজেদের বোঝাপড়ারও একটি প্রতীক। ভবিষ্যতে, ব্ল্যাক হোলের আরও গভীর রহস্য উন্মোচন আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেবে।