এই নিবন্ধে মঙ্গল গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা, নাসার রোভার মিশন, জলের অস্তিত্ব এবং বহির্জাগতিক জীবনের সন্ধানের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে মঙ্গল গ্রহের প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও এতে অন্তর্ভুক্ত।
মঙ্গল গ্রহ, যাকে আমরা ‘লাল গ্রহ’ বলে ডাকি, সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ। এর লালচে রঙ আসে মাটিতে থাকা আয়রন অক্সাইড (মরিচা) থেকে। পৃথিবীর মতোই মঙ্গল গ্রহে দিন-রাতের চক্র এবং ঋতুচক্র রয়েছে, যা এটিকে জীবনের সম্ভাবনার জন্য আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রাচীনকালে মঙ্গল গ্রহে তরল জলের নদী, হ্রদ এবং সম্ভবত সমুদ্র ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এই ধারণা জীবনের সম্ভাবনার প্রশ্নকে আরও জোরালো করে।
মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠের চিত্র, যেখানে লালচে মাটি এবং শিলাখণ্ড দেখানো হয়েছে। সংগৃহিত: ছবি
জীবনের অস্তিত্বের জন্য জল একটি অপরিহার্য উপাদান। নাসার মার্স রিকনেসান্স অর্বিটার এবং কিউরিওসিটি রোভার মঙ্গল গ্রহে তরল জলের প্রমাণ পেয়েছে, যদিও বর্তমানে এটি বেশিরভাগ হিমায়িত অবস্থায় বা মাটির নিচে রয়েছে। ২০১৫ সালে নাসা ঘোষণা করে যে মঙ্গল গ্রহে মৌসুমীভাবে তরল জলের প্রবাহের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই আবিষ্কার জীবনের সম্ভাবনার আশা জাগিয়েছে, কারণ পৃথিবীতে যেখানে জল আছে, সেখানেই জীবনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
মঙ্গল গ্রহে তরল জলের প্রবাহের প্রমাণ দেখানো একটি চিত্র। সংগৃহিত: ছবি
নাসার রোভার মিশনগুলি মঙ্গল গ্রহে জীবনের সন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০১২ সালে কিউরিওসিটি রোভার মঙ্গলের গেল ক্রেটারে অবতরণ করে এবং জৈব অণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করে। ২০২১ সালে পারসিভিয়ারেন্স রোভার জেজেরো ক্রেটারে অবতরণ করে, যেখানে একসময় একটি প্রাচীন হ্রদ ছিল। পারসিভিয়ারেন্স মাটি এবং শিলার নমুনা সংগ্রহ করছে, যা ভবিষ্যতে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে জীবনের প্রমাণ খুঁজে দেখা হবে। এই মিশনগুলি মঙ্গল গ্রহে অণুজীবের অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন আশা জাগিয়েছে।
পারসিভিয়ারেন্স রোভারের চিত্র, যা মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে গবেষণা করছে। সংগৃহিত: ছবি
মঙ্গল গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা শুধু বিজ্ঞানের বিষয় নয়, এটি মানুষের কল্পনাকেও উসকে দিয়েছে। SETI (Search for Extraterrestrial Intelligence) প্রকল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বহির্জাগতিক সভ্যতার সংকেত খুঁজছেন। যদিও মঙ্গল গ্রহে বুদ্ধিমান জীবনের সম্ভাবনা কম, অণুজীবের অস্তিত্বের সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। বাংলা কল্পবিজ্ঞানে, জগদানন্দ রায়ের “শুক্র ভ্রমণ” এবং সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে মঙ্গল গ্রহ এবং এলিয়েন জীবনের কল্পনা করা হয়েছে, যা বিজ্ঞান ও কল্পনার এক অনন্য মিশ্রণ।
মঙ্গল গ্রহে অণুজীব জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে কল্পিত চিত্র। সংগৃহিত: ছবি
মঙ্গল গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। এর পৃষ্ঠে তীব্র বিকিরণ, নিম্ন তাপমাত্রা এবং পাতলা বায়ুমণ্ডল জীবনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে। তবে, পৃথিবীর চরম পরিবেশে (যেমন, আন্টার্কটিকার শুষ্ক উপত্যকা বা গভীর সমুদ্রের তাপপ্রবাহ) অণুজীবের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে জীবন অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। মঙ্গল গ্রহের মাটির নিচে বা হিমায়িত জলাশয়ে এমন জীবন থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
মঙ্গল গ্রহের প্রতিকূল পরিবেশের চিত্র, যেখানে শুষ্ক ভূমি ও ধুলো ঝড় দেখানো হয়েছে। সংগৃহিত: ছবি
বাংলা সাহিত্যে মঙ্গল গ্রহ সবসময়ই কল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। জগদীশচন্দ্র বসুর “নিরুদ্দেশের কাহিনী” বাংলা কল্পবিজ্ঞানের প্রথম ধাপ হলেও, সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শঙ্কু সিরিজে মঙ্গল গ্রহ এবং বহির্জাগতিক জীবনের ধারণা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁর গল্পে বিজ্ঞান ও কল্পনার মিশ্রণ মঙ্গল গ্রহকে একটি রোমাঞ্চকর বিষয় করে তুলেছে। আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞানেও এই প্রভাব অব্যাহত রয়েছে।
মঙ্গল গ্রহে জীবনের সন্ধানের পাশাপাশি, মানুষের বসতি স্থাপনের সম্ভাবনাও বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করছে। ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানি ২০৩০-এর দশকে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। নাসা এবং ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সিও মঙ্গল গ্রহে মানুষের মিশনের জন্য প্রযুক্তি উন্নয়ন করছে। এই অভিযানগুলি জীবনের সন্ধানের পাশাপাশি মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা পরীক্ষা করবে।
মঙ্গল গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্নটি আমাদের মুগ্ধ করে: আমরা কি মহাবিশ্বে একা? নাসার রোভার মিশন, জলের প্রমাণ এবং জৈব অণুর আবিষ্কার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করছে। বাংলা কল্পবিজ্ঞান এই বিষয়কে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। ভবিষ্যতে, মঙ্গল গ্রহে জীবনের প্রমাণ বা মানুষের বসতি আমাদের বাস্তবতার ধারণাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।