04 May
04May

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের জন্য একটি গুরুতর হুমকি, এবং কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি (CCS) এই সমস্যা মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এই প্রযুক্তি কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) সংগ্রহ করে ভূগর্ভে সঞ্চয় করে বা পুনরায় ব্যবহার করে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমায়। 

এই নিবন্ধে আমরা কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এর ভূমিকা, বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা, এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করব।

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি কী?

কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ (CCS) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যা শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, বা সরাসরি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড সংগ্রহ করে। এই CO₂ তারপর ভূগর্ভে নিরাপদে সঞ্চয় করা হয় বা জ্বালানি, রাসায়নিক পদার্থ, বা নির্মাণ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। CCS তিনটি প্রধান ধাপে কাজ করে:

  • ক্যাপচার: শিল্প প্রক্রিয়া বা বায়ু থেকে CO₂ আলাদা করা।
  • পরিবহন: পাইপলাইন বা অন্যান্য মাধ্যমে CO₂ সঞ্চয়স্থানে পৌঁছানো।
  • সঞ্চয় বা ব্যবহার: CO₂ ভূগর্ভে সঞ্চয় করা বা পুনরায় ব্যবহার করা।

কীভাবে কার্বন ক্যাপচার জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করছে?

১. গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস

কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রধান উৎস, যা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। CCS প্রযুক্তি শিল্প কারখানা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রায় ৯০% পর্যন্ত CO₂ সংগ্রহ করতে পারে, যা বায়ুমণ্ডলে নির্গমন কমায়।

২. শিল্প খাতে কার্বন নিরপেক্ষতা

সিমেন্ট, ইস্পাত, এবং রাসায়নিক শিল্পের মতো খাত থেকে প্রচুর পরিমাণে CO₂ নির্গমন হয়। CCS এই শিল্পগুলোকে কার্বন নিরপেক্ষ করতে সহায়তা করে, যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অপরিহার্য।

৩. সরাসরি এয়ার ক্যাপচার (DAC)

ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার (DAC) প্রযুক্তি বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি CO₂ সংগ্রহ করে। এটি ঐতিহাসিক নির্গমন হ্রাসে সহায়তা করে এবং নেগেটিভ কার্বন ইমিশন তৈরি করতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিপরীত করতে গুরুত্বপূর্ণ।

৪. কার্বন পুনঃব্যবহার

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি শুধু সঞ্চয়ই করে না, বরং CO₂ কে জ্বালানি, প্লাস্টিক, বা নির্মাণ সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, CO₂ থেকে সিন্থেটিক জ্বালানি তৈরি করা যায়, যা জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমায়।

৫. জীবাশ্ম জ্বালানির ট্রানজিশন সহজতর করা

নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ত্বরান্বিত হলেও, জীবাশ্ম জ্বালানি এখনও অনেক দেশের শক্তি ব্যবস্থার মূল অংশ। CCS জীবাশ্ম জ্বালানি-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নির্গমন কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে রূপান্তর সহজ করে।

৬. জলবায়ু লক্ষ্য অর্জন

প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অনুযায়ী, গ্লোবাল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫°C-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। CCS প্রযুক্তি বৈশ্বিক নির্গমন হ্রাসে সহায়তা করে এই লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির প্রকার

১. পোস্ট-কম্বাশন ক্যাপচার

এই পদ্ধতিতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর পর উৎপন্ন ফ্লু গ্যাস থেকে CO₂ আলাদা করা হয়। এটি বিদ্যমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শিল্প কারখানায় সহজেই সংযোজন করা যায়।

২. প্রি-কম্বাশন ক্যাপচার

এই প্রক্রিয়ায় জ্বালানি পোড়ানোর আগে গ্যাসীকরণের মাধ্যমে CO₂ আলাদা করা হয়। এটি প্রধানত কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়।

৩. অক্সি-ফুয়েল কম্বাশন

এই পদ্ধতিতে জ্বালানি বিশুদ্ধ অক্সিজেনে পোড়ানো হয়, যা প্রায় বিশুদ্ধ CO₂ উৎপন্ন করে। এটি ক্যাপচার প্রক্রিয়াকে সহজ করে।

৪. ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার (DAC)

DAC প্রযুক্তি বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি CO₂ সংগ্রহ করে। এটি অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

কীভাবে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করতে পারে: টেকসই ভবিষ্যতের পথে

বাংলাদেশে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির সম্ভাবনা

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। যদিও দেশটির কার্বন নির্গমন বৈশ্বিক পরিমাণের তুলনায় কম, শিল্পায়ন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। CCS প্রযুক্তি বাংলাদেশে নিম্নলিখিত উপায়ে অবদান রাখতে পারে:

  • শিল্প খাতে প্রয়োগ: বাংলাদেশের সিমেন্ট, ইটভাটা, এবং টেক্সটাইল শিল্পে CCS প্রয়োগ করে নির্গমন কমানো সম্ভব।
  • বিদ্যুৎ কেন্দ্র: কয়লা এবং গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে CCS সংযোজন করে কার্বন নির্গমন হ্রাস করা যায়।
  • অর্থনৈতিক সুবিধা: CCS শিল্পে বিনিয়োগ নতুন কর্মসংস্থান এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
  • জলবায়ু লক্ষ্য: বাংলাদেশের জাতীয় নির্গমন হ্রাস লক্ষ্য (NDC) অর্জনে CCS সহায়তা করতে পারে।

তবে, বাংলাদেশে CCS প্রযুক্তি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং ব্যাপক প্রয়োগের জন্য গবেষণা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।

চ্যালেঞ্জসমূহ

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির সম্ভাবনা থাকলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • উচ্চ খরচ: CCS স্থাপনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল। DAC প্রযুক্তি বিশেষ করে ব্যয়বহুল।
  • শক্তি খরচ: কার্বন ক্যাপচার প্রক্রিয়া নিজেই প্রচুর শক্তি ব্যবহার করে, যা অতিরিক্ত নির্গমনের কারণ হতে পারে।
  • সঞ্চয় নিরাপত্তা: ভূগর্ভে CO₂ সঞ্চয় নিরাপদ হলেও ফুটো হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  • অবকাঠামোর অভাব: বাংলাদেশে CCS-এর জন্য পাইপলাইন এবং সঞ্চয়স্থানের অবকাঠামো সীমিত।
  • জনসচেতনতা: CCS প্রযুক্তি সম্পর্কে জনসাধারণ এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব।

বাংলাদেশের জন্য করণীয়

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

  1. CCS গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো।
  2. শিল্প কারখানায় CCS পাইলট প্রকল্প চালু করা।
  3. আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতা করে প্রযুক্তি হস্তান্তর ও অর্থায়ন নিশ্চিত করা।
  4. CCS প্রযুক্তির নিরাপত্তা ও সুবিধা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
  5. নীতিমালা প্রণয়ন করে CCS প্রয়োগে শিল্প মালিকদের উৎসাহিত করা।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিছু সম্ভাব্য ক্ষেত্র হলো:

  • খরচ হ্রাস: প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে CCS এবং DAC-এর খরচ কমবে।
  • কার্বন অর্থনীতি: কার্বন পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে নতুন শিল্প, যেমন সিন্থেটিক জ্বালানি উৎপাদন, গড়ে উঠবে।
  • নেগেটিভ ইমিশন: DAC এবং বায়ো-এনার্জি উইথ কার্বন ক্যাপচার (BECCS) নেগেটিভ কার্বন ইমিশন তৈরি করবে।
  • বৈশ্বিক প্রভাব: CCS বৈশ্বিক নির্গমন হ্রাসে অবদান রেখে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশে CCS প্রযুক্তি শিল্পায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।

উপসংহার

কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এটি কার্বন ডাই অক্সাইড সংগ্রহ, সঞ্চয়, এবং পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়তা করছে। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি শিল্প নির্গমন কমাতে এবং জাতীয় জলবায়ু লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, উচ্চ খরচ, অবকাঠামোর অভাব, এবং জনসচেতনতার ঘাটতি মোকাবিলা করা প্রয়োজন। সঠিক নীতিমালা, বিনিয়োগ, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

Comments
* The email will not be published on the website.