21 Jul
21Jul

বাংলাদেশের বায়োটেক স্টার্টআপ খাত ২০২৫ সালে উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা প্রদর্শন করছে, যা দেশের অর্থনীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য, এবং পরিবেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বায়োটেকনোলজি, বিশেষ করে কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, এবং পরিবেশগত সমাধানে উদ্ভাবনের মাধ্যমে, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে এবং টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম। নিচে এই খাতের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

সম্ভাবনা:

  1. কৃষিতে বিপ্লব:
    • বায়োটেকনোলজি কৃষিক্ষেত্রে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, এবং লবণাক্ততা ও জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ফসল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, জিনগতভাবে পরিবর্তিত ফসল এবং উন্নত বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকরা কম জমিতে বেশি ফলন পেতে পারেন।
    • বাংলাদেশের ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বায়োটেক স্টার্টআপগুলো নতুন জাতের ফল, সবজি, এবং মাছ উৎপাদনে কাজ করছে।
  2. স্বাস্থ্যসেবায় উদ্ভাবন:
    • বাংলাদেশি বায়োটেক স্টার্টআপগুলো স্বাস্থ্যসেবা খাতে ভ্যাকসিন, ডায়াগনস্টিক কিট, এবং বায়ো-ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদনে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্লোব বায়োটেক ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সফলতা অর্জন করেছিল, যা এই খাতের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে।
    • টেলিমেডিসিন এবং ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্মের সাথে বায়োটেকনোলজির সমন্বয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘ডক্টরোলা’ নামক একটি স্টার্টআপ ৫৫০টি হাসপাতালের ৮,০০০ চিকিৎসককে একটি প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করেছে।
  3. পরিবেশগত সমাধান:
    • বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন, যেমন ড. মাকসুদুর রহমানের উদ্ভিজ্জ বায়োপলিমার, প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে টেকসই বিকল্প প্রদান করছে। এই ধরনের উদ্ভাবন পরিবেশ-বান্ধব পণ্য উৎপাদন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
    • বায়োটেক স্টার্টআপগুলো বায়োডিগ্রেডেবল উপকরণ এবং বর্জ্য থেকে জৈব জ্বালানি উৎপাদনে কাজ করতে পারে, যা বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক হবে।
  4. বিদেশি বিনিয়োগ এবং বাজার সম্প্রসারণ:
    • বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, শপআপ এবং চালডালের মতো স্টার্টআপগুলো বিদেশি ফান্ড থেকে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ পেয়েছে। বায়োটেক স্টার্টআপগুলোও এই প্রবণতা থেকে উপকৃত হতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা উদ্ভাবনী সমাধান প্রদান করতে পারে।
    • বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে উন্নত ইন্টারনেট সংযোগ এবং ডিজিটাল অবকাঠামো বায়োটেক স্টার্টআপগুলোর জন্য ডেটা-চালিত গবেষণা এবং বিশ্বব্যাপী বাজারে প্রবেশকে সহজ করছে।
  5. সরকারি সহায়তা এবং ডিজিটাল অবকাঠামো:
    • সরকার প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ এবং নীতিগত সহায়তা প্রদান করছে, যা বায়োটেক স্টার্টআপগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, বিটিআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭ কোটি ছাড়িয়েছে, যা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-ভিত্তিক বায়োটেক সেবার প্রসারে সহায়ক।
    • ই-গভর্নেন্স এবং উদ্ভাবন কর্মপরিকল্পনা ২০২৩-২৪ এর মাধ্যমে সরকার নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহিত করছে।

চ্যালেঞ্জ:

  1. গবেষণায় অপ্রতুল বিনিয়োগ:
    • বাংলাদেশে গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) এর জন্য বরাদ্দ খুবই কম। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারত জিডিপির ০.৩% এবং পাকিস্তান ০.১% গবেষণায় ব্যয় করে, কিন্তু বাংলাদেশের তথ্য এ বিষয়ে অনুপস্থিত। এই অভাব মৌলিক উদ্ভাবনের পথে বাধা।
    • স্টার্টআপগুলো প্রায়শই বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে, যা স্থানীয় সমস্যার জন্য উপযোগী সমাধান তৈরিতে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।
  2. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা:
    • ২০২৫ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, এবং ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতার মুখোমুখি। এই পরিস্থিতি স্টার্টআপগুলোর জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং টেকসই ব্যবসায়িক মডেল গড়ে তুলতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
  3. দক্ষ জনশক্তির অভাব:
    • বায়োটেক খাতে দক্ষ জনশক্তি এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করলেও গবেষণা এবং ব্যবহারিক শিক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে।
  4. বাজারে প্রতারণা এবং আস্থার ঘাটতি:
    • ই-কমার্স এবং অন্যান্য স্টার্টআপ খাতে প্রতারণার ঘটনা বিনিয়োগকারী এবং গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে, যা বায়োটেক স্টার্টআপগুলোর জন্যও ঝুঁকি।
  5. নিয়ন্ত্রক ও নৈতিক বিষয়:
    • জিনগতভাবে পরিবর্তিত ফসল এবং বায়োটেক পণ্য নিয়ে নৈতিক ও নিয়ন্ত্রক প্রশ্ন রয়েছে। এই বিষয়গুলো সঠিকভাবে সমাধান না করলে বাজার গ্রহণযোগ্যতা কমতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:

  • গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি: সরকার এবং বেসরকারি খাত যদি গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ায়, তবে বায়োটেক স্টার্টআপগুলো মৌলিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: জাপানের Kyushu Institute of Technology-এর সাথে BRAC Onnesha ন্যানোস্যাটেলাইট প্রকল্পের মতো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বায়োটেক খাতে প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে।
  • ইউনিকর্ন স্টার্টআপের সম্ভাবনা: বিকাশের মতো সফল স্টার্টআপের পথ অনুসরণ করে বায়োটেক খাতে ইউনিকর্ন (১ বিলিয়ন ডলার মূল্যায়ন) স্টার্টআপ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।

উপসংহার:

বাংলাদেশের বায়োটেক স্টার্টআপ খাত কৃষি, স্বাস্থ্য, এবং পরিবেশের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা রাখে। তবে, এই সম্ভাবনা পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য গবেষণায় বিনিয়োগ, দক্ষ জনশক্তি উন্নয়ন, এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন। সরকার, বেসরকারি খাত, এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ বায়োটেক স্টার্টআপের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে।

মন্তব্যসমূহ
* ইমেইলটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে না।