শেভরন কর্পোরেশন (Chevron Corporation) বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সমন্বিত শক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি, যার সদর দপ্তর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত। ১৮০টিরও বেশি দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী এই কোম্পানি আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ও গ্যাস প্রতিষ্ঠান। শেভরন কেবল তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদনেই নয়, বরং পরিশোধন, বিপণন, রাসায়নিক উৎপাদন, এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। “দ্য হিউম্যান এনার্জি কোম্পানি” স্লোগানের এই প্রতিষ্ঠানটি শক্তি শিল্পে উদ্ভাবন এবং স্থায়িত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই ব্লগে আমরা শেভরনের ইতিহাস, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ, এবং বিশ্বব্যাপী শক্তি বাজারে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
শেভরনের যাত্রা শুরু হয় ১৮৭৯ সালে, প্যাসিফিক কোস্ট অয়েল কোম্পানি নামে ক্যালিফোর্নিয়ার তেল শিল্পে। ১৯০০ সালে এটি স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের অধীনে আসে এবং ১৯১১ সালে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ভেঙে যাওয়ার পর এটি স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অফ ক্যালিফোর্নিয়া (সোকাল) নামে পরিচিত হয়। ১৯৮৪ সালে গালফ অয়েল অধিগ্রহণের মাধ্যমে কোম্পানিটি শেভরন নাম গ্রহণ করে, যা তখনকার সময়ের বৃহত্তম সংযুক্তির একটি ছিল। পরবর্তীতে, ২০০১ সালে টেক্সাকো এবং ২০০৫ সালে ইউনোকাল অধিগ্রহণ শেভরনকে বিশ্বব্যাপী শক্তি শিল্পে একটি শীর্ষস্থানীয় নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।২০২৩ সালে, শেভরন ৫৩ বিলিয়ন ডলারে হেস কর্পোরেশন অধিগ্রহণ করে, যার ফলে গায়ানা এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেল অঞ্চলে তেল সম্পদে তাদের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, ২০২০ সালে নোবেল এনার্জি এবং ২০২২ সালে রিনিউয়েবল এনার্জি গ্রুপ অধিগ্রহণের মাধ্যমে শেভরন ঐতিহ্যবাহী এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উভয় ক্ষেত্রে তাদের পোর্টফোলিও প্রসারিত করেছে। ২০২৪ সালে, শেভরন তাদের সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান র্যামন থেকে টেক্সাসের হিউস্টনে স্থানান্তরের ঘোষণা দেয়, যা শক্তি বাজারে তাদের কৌশলগত ফোকাস প্রতিফলিত করে।
শেভরন দুটি প্রধান বিভাগে কাজ করে: আপস্ট্রিম (তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, উৎপাদন, এবং পরিবহন) এবং ডাউনস্ট্রিম (পরিশোধন, বিপণন, এবং জ্বালানি, লুব্রিকেন্ট ও রাসায়নিক উৎপাদন)। এর প্রধান কার্যক্রম এলাকার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গালফ কোস্ট, পারমিয়ান বেসিন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০২৪ সালে, শেভরনের যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন ১.৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল-সমতুল্য উৎপাদন হয়, যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পারমিয়ান বেসিন থেকে আসে। কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচটি পরিশোধনাগার পরিচালনা করে এবং দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, এবং সিঙ্গাপুরে যৌথ উদ্যোগে পরিশোধনাগারে অংশীদারিত্ব রয়েছে।শেভরন, টেক্সাকো, এবং ক্যালটেক্স ব্র্যান্ডের অধীনে জ্বালানি বিক্রি করে, যুক্তরাষ্ট্রে ৮,০০০টিরও বেশি সার্ভিস স্টেশন রয়েছে। এর পাইপলাইন এবং বিদ্যুৎ কার্যক্রম শক্তির দক্ষতা বাড়ায়, এবং এর শিপিং সহযোগী সংস্থা সমুদ্রপথে পরিবহন পরিচালনা করে। শেভরনের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক এটিকে শক্তি শিল্পে একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শেভরন তার কার্যক্রমের দক্ষতা বাড়াতে এবং পরিবেশগত প্রভাব কমাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এর মালিকানাধীন কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ (CCS) প্রযুক্তি এবং ডাইরেক্ট লিথিয়াম এক্সট্রাকশন (DLE) প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ২০২৫ সালে, শেভরন স্ম্যাকওভার ফরমেশনে লিজহোল্ড অবস্থান অধিগ্রহণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের লিথিয়াম খাতে প্রবেশ করে, যা বৈদ্যুতিকরণের জন্য লিথিয়াম সরবরাহে শক্তি নিরাপত্তা বাড়াতে সহায়তা করবে। কোম্পানিটির ৪,৮০০টিরও বেশি প্রযুক্তি পেটেন্ট রয়েছে, যা এটিকে শক্তি উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেয়।শেভরনের ওপেন কানেক্ট কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক এবং জিই ভার্নোভার মতো প্রযুক্তি সংস্থার সাথে অংশীদারিত্ব এআই ডেটা সেন্টারের জন্য নির্ভরযোগ্য শক্তি সমাধান প্রদান করে। ২০৩০ সালের মধ্যে এর পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন প্রতিদিন ১০০,০০০ ব্যারেলে পৌঁছানোর লক্ষ্য রয়েছে।
শেভরন জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের জন্য কম কার্বন সমাধানে বিনিয়োগ করছে। এর উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে:
শেভরন ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমনের লক্ষ্য রাখে, যদিও এই লক্ষ্য অ-বাধ্যতামূলক হওয়ায় কিছু সমালোচনার মুখে পড়েছে। কোম্পানিটি বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিকল্প জ্বালানিতে বিনিয়োগ করে এবং জাতীয় পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি গবেষণাগারের সাথে অ্যালগি থেকে বায়োজ্বালানি উন্নয়নে কাজ করছে।
শেভরনের কার্যক্রম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য সমালোচিত হয়েছে। ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় শেভরনকে ১৯৬৫ সাল থেকে ৪৩.৩৫ বিলিয়ন টন CO2 সমতুল্য নির্গমনের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইকুয়েডর এবং নাইজেরিয়ার মতো অঞ্চলে পরিবেশগত ক্ষতির জন্য মামলা মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে, শেভরন নির্গমন কমানোর এবং শেভরন হিউম্যানকাইন্ড প্রোগ্রামের মাধ্যমে সম্প্রদায়ের উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটি গ্লোবাল সুলিভান প্রিন্সিপলস সমর্থন করে এবং বৈচিত্র্য প্রচারে অফিস অফ গ্লোবাল ডাইভার্সিটি পরিচালনা করে।
২০২০ সালের তেলের দাম পতন এবং কোভিড-১৯ মহামারীর সময় শেভরন ১০-১৫% কর্মী ছাঁটাই করে। ২০২৫ সালে, এটি ২০২৬ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ২০% কর্মী হ্রাসের পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যার মধ্যে টেক্সাসে ৮০০ এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় ৬০০ চাকরি রয়েছে, যা ২-৩ বিলিয়ন ডলার খরচ কমাবে। ২০২৪ সালে বাজারের পরিস্থিতির কারণে শেল সম্প্রসারণ হ্রাস করা হয়। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় শেভরনের লাইসেন্স বাতিল করে, যা এর আঞ্চলিক কৌশলকে প্রভাবিত করে। তবে, ২০২২ সালে ৩৬.৫ বিলিয়ন ডলার মুনাফা এবং ৭৫ বিলিয়ন ডলারের শেয়ার পুনরায় ক্রয় প্রোগ্রাম এর আর্থিক শক্তি প্রতিফলিত করে।
শেভরন ২০২৬ সালের মধ্যে গালফ অফ মেক্সিকোতে প্রতিদিন ৩০০,০০০ ব্যারেল তেল-সমতুল্য উৎপাদনের লক্ষ্য রাখে। লিথিয়াম, হাইড্রোজেন, এবং CCS-এ বিনিয়োগ ক্লিনার শক্তির চাহিদা মেটাবে। হেস কর্পোরেশনের মতো অধিগ্রহণ গায়ানার তেলক্ষেত্রে এর উপস্থিতি বাড়াবে।
শেভরন কর্পোরেশন তেল ও গ্যাস শিল্পে তার ঐতিহ্যের সাথে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিতে উদ্ভাবনের সমন্বয় ঘটিয়ে শক্তি শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পরিবেশগত ও নিয়ন্ত্রণমূলক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, এর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং কৌশলগত বিনিয়োগ সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, এবং পরিচ্ছন্ন শক্তি সরবরাহে নেতৃত্ব দেয়।