টাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) হল বিশ্বের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে মূল্যবান সেমিকন্ডাক্টর ফাউন্ড্রি, যা তাইওয়ানের হসিনচু সায়েন্স পার্কে অবস্থিত। ১৯৮৭ সালে মরিস চ্যাং দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, টিএসএমসি বিশ্বের প্রথম ডেডিকেটেড ফাউন্ড্রি মডেল প্রবর্তন করে, যা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে বিপ্লব ঘটায়। এটি অ্যাপল, এনভিডিয়া, কোয়ালকম এবং এএমডি-এর মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের জন্য চিপ তৈরি করে, যা স্মার্টফোন, এআই, অটোমোটিভ এবং উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিংকে শক্তি দেয়। ২০২৪ সালে, টিএসএমসি ১৬ মিলিয়ন ১২-ইঞ্চি সমতুল্য ওয়েফারের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করে এবং বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ৩-ন্যানোমিটার চিপ তৈরির নেতৃত্ব দেয়।
এই ব্লগে আমরা টিএসএমসি-র যাত্রা, উদ্ভাবন, বৈশ্বিক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
১৯৮৭ সালে, তাইওয়ান সরকারের সমর্থনে এবং ফিলিপসের প্রযুক্তিগত সহায়তায় মরিস চ্যাং টিএসএমসি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস ম্যানুফ্যাকচারার (আইডিএম) মডেল প্রাধান্য ছিল, যেখানে কোম্পানিগুলো নিজেরাই চিপ ডিজাইন এবং উৎপাদন করত। টিএসএমসি বিশ্বের প্রথম “পিওর-প্লে” ফাউন্ড্রি মডেল প্রবর্তন করে, যেখানে এটি শুধুমাত্র অন্য কোম্পানির ডিজাইন করা চিপ তৈরির উপর ফোকাস করে। এই মডেল ফ্যাবলেস কোম্পানিগুলোর জন্য পথ খুলে দেয়, যেমন এনভিডিয়া এবং কোয়ালকম, যারা নিজেদের উৎপাদন সুবিধা ছাড়াই উদ্ভাবন করতে পারে।
তাইওয়ান সরকার ৪৮% মূলধন এবং ফিলিপস ২৭.৫% শেয়ারের মাধ্যমে টিএসএমসি-কে সমর্থন করে। মরিস চ্যাং-এর দূরদর্শী নেতৃত্বে, টিএসএমসি দ্রুত স্কেল করে এবং ১৯৯৩ সালে তাইওয়ান স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়।
মরিস চ্যাং, যিনি তাইওয়ানের “চিপের গডফাদার” নামে পরিচিত, টিএসএমসি-কে বিশ্ব নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ১৯৩১ সালে চীনে জন্মগ্রহণকারী চ্যাং এমআইটি থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টসে কাজ করেন। তিনি তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ার জন্য সরকারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং টিএসএমসি-র মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে তাইওয়ানের স্থান নিশ্চিত করেন। ২০১৮ সালে অবসর নেওয়ার আগে, তিনি টিএসএমসি-কে ৭-ন্যানোমিটার প্রযুক্তির অগ্রগামী করে তোলেন। তার “গ্রাহকের আস্থা” এবং “প্রযুক্তি নেতৃত্ব” দর্শন টিএসএমসি-র সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
২০১৮ সালে মরিস চ্যাং অবসর নিলে মার্ক লিউ চেয়ারম্যান এবং সি.সি. ওয়েই সিইও হন। তাদের নেতৃত্বে টিএসএমসি ৫-ন্যানোমিটার এবং ৩-ন্যানোমিটার প্রযুক্তি বাণিজ্যিকীকরণ করে, যা অ্যাপল এ১৪, এম১ এবং এএমডি রাইজেন ৭০০০ সিরিজের মতো চিপগুলোতে ব্যবহৃত হয়। তারা এআই এবং হাই-পারফরম্যান্স কম্পিউটিং (এইচপিসি)-এর জন্য উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, যেমন ৩ডিফ্যাব্রিক এবং সো আই সি, প্রবর্তন করে।
টিএসএমসি বিশ্বের প্রথম ফাউন্ড্রি যিনি ৭-ন্যানোমিটার এবং ৫-ন্যানোমিটার উৎপাদন ক্ষমতা বাজারে আনেন। এটি এএসএমএল-এর এক্সট্রিম আল্ট্রাভায়োলেট (ইইউভি) লিথোগ্রাফি প্রযুক্তির বৃহৎ পরিসরে ব্যবহার করে। ২০২৪ সালে, টিএসএমসি ৩-ন্যানোমিটার চিপ উৎপাদন শুরু করে, যা শক্তি দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি নিয়ে আসে। এই চিপগুলো এআই, ৫জি, এবং অটোমোটিভ অ্যাপ্লিকেশনের জন্য অপরিহার্য। টিএসএমসি ২০২৫ সালে এ১৪ প্রক্রিয়া উন্মোচন করে, যা এআই এবং এইচপিসি-এর জন্য আরও উন্নত প্রযুক্তি প্রদান করবে।
টিএসএমসি-র গবেষণা বিভাগ ন্যানোসিট ট্রানজিস্টর, উচ্চ-মোবিলিটি চ্যানেল এবং কম-মাত্রিক উপকরণ নিয়ে কাজ করে। এটি এসটিটি-এমআরএএম এবং আরআরএএম-এর মতো নন-ভোলাটাইল মেমোরি সমাধানও অনুসন্ধান করছে, যা এআই এজ ডিভাইসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
টিএসএমসি-র প্রধান কার্যক্রম তাইওয়ানে অবস্থিত, যেখানে এটি চারটি ১২-ইঞ্চি গিগাফ্যাব, চারটি ৮-ইঞ্চি ফ্যাব এবং একটি ৬-ইঞ্চি ফ্যাব পরিচালনা করে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (টিএসএমসি অ্যারিজোনা), চীনে (টিএসএমসি নানজিং), এবং জাপানে (জেএএসএম) ফ্যাব পরিচালনা করে। ২০২৪ সালে, টিএসএমসি জার্মানির ড্রেসডেনে একটি বিশেষ প্রযুক্তি ফ্যাব নির্মাণ শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, টিএসএমসি অ্যারিজোনায় তিনটি ফ্যাব নির্মাণ করছে, যার মোট বিনিয়োগ ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই সম্প্রসারণ ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলার বৈচিত্র্যের চাহিদার প্রতিক্রিয়া।
টিএসএমসি ২০২৪ সালে ৫২২ গ্রাহকের জন্য ১১,৮৭৮টি পণ্য তৈরি করে, যা স্মার্টফোন, এআই, অটোমোটিভ এবং আইওটি-এর জন্য ব্যবহৃত হয়। এর গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, এনভিডিয়া, এএমডি, কোয়ালকম এবং মিডিয়াটেক। টিএসএমসি বিশ্বের ৯২% উন্নত চিপ উৎপাদন করে, যা এটিকে প্রযুক্তি সরবরাহ শৃঙ্খলায় অপরিহার্য করে তোলে। তাইওয়ানের অর্থনীতিতে টিএসএমসি-র অবদান উল্লেখযোগ্য, যা দেশের জিডিপির প্রায় ২৫% রপ্তানি এবং তাইওয়ান স্টক এক্সচেঞ্জের ৩০% প্রতিনিধিত্ব করে।
টিএসএমসি-র আধিপত্য তাইওয়ানকে “সিলিকন শিল্ড” হিসেবে অভিহিত করেছে, যা ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখে। মার্কিন-চীন উত্তেজনা এবং তাইওয়ানের নিরাপত্তা উদ্বেগের মধ্যে, টিএসএমসি-র ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিপস অ্যান্ড সায়েন্স অ্যাক্টের মাধ্যমে টিএসএমসি-কে ৬.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে মার্কিন উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত করেছে। তবে, টিএসএমসি-র বেশিরভাগ উৎপাদন তাইওয়ানে থাকায়, এটি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলার জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
টিএসএমসি ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমন অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এটি অ্যাপলের সাথে রিস্টোর ফান্ডে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে এবং সরবরাহকারীদের জন্য পরিবেশগত তথ্য প্ল্যাটফর্ম চালু করে। ২০২৪ সালে, ৪২৯টি কারখানা এই প্ল্যাটফর্ম থেকে উপকৃত হয়। টিএসএমসি-র টেকসই পদক্ষেপগুলো শিল্পে একটি মানদণ্ড স্থাপন করছে।
টিএসএমসি সম্পদের চ্যালেঞ্জ, যেমন জমি, পানি এবং বিদ্যুৎ, এবং প্রতিভার ঘাটতির মুখোমুখি। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং মার্কিন-চীন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এর ব্যবসায় প্রভাব ফেলে। ২০২৪ সালে, টিএসএমসি-র শেয়ার মূল্য ৬.৭% হ্রাস পায় যখন এটি চিপ শিল্পের বৃদ্ধির পূর্বাভাস কমায়। তবুও, টিএসএমসি-র প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব এবং গ্রাহক আস্থা এটিকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখে।
টিএসএমসি এআই, ৫জি এবং অটোমোটিভ শিল্পে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। এটি ২-ন্যানোমিটার প্রযুক্তি এবং উচ্চ-ব্যান্ডউইথ মেমোরি (এইচবিএম৪) নিয়ে গবেষণা করছে। এর ওপেন ইনোভেশন প্ল্যাটফর্ম স্টার্টআপ এবং গ্রাহকদের উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে। টিএসএমসি-র বৈশ্বিক সম্প্রসারণ এবং টেকসই প্রতিশ্রুতি এটিকে ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ল্যান্ডস্কেপে একটি মূল খেলোয়াড় হিসেবে অবস্থান করছে।
টিএসএমসি তাইওয়ানের একটি ছোট স্টার্টআপ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। এর উদ্ভাবনী ফাউন্ড্রি মডেল, উন্নত প্রযুক্তি এবং গ্রাহককেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রযুক্তি শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এআই, স্মার্টফোন এবং অটোমোটিভের ভবিষ্যৎ গঠনে টিএসএমসি-র ভূমিকা অপরিসীম। ভূ-রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, টিএসএমসি-র প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব এবং তাইওয়ানের “সিলিকন শিল্ড” এটিকে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির কেন্দ্রে রাখবে।