12 Oct
12Oct

ভূমিকা

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা বিপন্ন। জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুর্ভোগের ক্ষেত্রে অষ্টম স্থানে রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জলবায়ু সহনশীল (ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট) প্রযুক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রযুক্তিগুলো কৃষি, অবকাঠামো, শিক্ষা এবং জীবিকা উন্নয়নে ব্যবহার হয়ে বিপদের মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। ২০২৫ সালে ADB-এর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (CRID) এবং IFAD-এর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড লাইভলিহুড এনহান্সমেন্ট প্রোজেক্ট (CRALEP)-এর মতো উদ্যোগগুলো এই দিকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

এই লেখায় আমরা বাংলাদেশে সহনশীল প্রযুক্তির ব্যবহার, উদাহরণ, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব। এটি গবেষক, নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য উপযোগী।

কৃষি খাতে সহনশীল প্রযুক্তির প্রয়োগ

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ কৃষি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা, বন্যা এবং খরা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। এখানে আন্তর্জাতিক রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IRRI)-এর মতো সংস্থা সহনশীল প্রযুক্তি প্রচার করছে। ২০২৫ সালের মে মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় IRRI-এর কর্মকর্তারা লবণাক্ততা এবং জলাবদ্ধতার মোকাবিলায় উদ্ভাবিত প্রযুক্তি উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে উন্নত কৃষি পদ্ধতি, যান্ত্রিকীকরণ এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত। ড. শরীফ আহমেদের উপস্থাপনায় দেখানো হয় যে, এই পদ্ধতিগুলো ছোট কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে বাজারের সুযোগ তৈরি করছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ টুল হলো CS-MAP, যা জল এবং জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। ড. আহমাদ সালাহুদ্দিনের মতে, এটি সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে লো-লাইং পোল্ডারে সহনশীল কৃষি বাস্তবায়ন করে। এছাড়া, ক্লাইমেট-রেজিলিয়েন্ট কমিউনিটি ফার্মিং সিস্টেম (CCFS) মডেল সম্প্রদায়ের সমন্বিত কাজ এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনকে একীভূত করে উপকূলীয় পোল্ডারে টেকসই উন্নয়নের পথ দেখায়। এই মডেল ফলন বাড়িয়ে জীবিকা উন্নত করছে।

ইউএসএইড-এর ফিড দ্য ফিউচার বাংলাদেশ ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার প্রোজেক্ট (২০২৩-২০২৮) ধান, ডাল, তেলবীজ এবং সবজির জন্য সহনশীল বীজ ব্যবস্থা শক্তিশালী করছে। ২০২৩ সালে ৩০ একরে ডাল এবং তেলবীজের CSA ডেমোনস্ট্রেশন এবং ধান ও সবজির ১৩টি ফিল্ড ডেমো চালানো হয়। এটি ৯০০,০০০ কৃষককে কভার করবে এবং ফসলের উৎপাদন ৫-১০% বাড়াবে। উর্বরক হ্রাস করে ৪৫৪,০০০ মেট্রিক টন সাশ্রয় হবে। তবে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউএসএইডের টার্মিনেশন নোটিসের কারণে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

ওয়েগিনেন ইউনিভার্সিটি (WUR)-এর নতুন প্রকল্প উপকূলীয় কৃষকদের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে সহনশীল ফসল এবং মাটি ব্যবস্থাপনা প্রচার করছে। এছাড়া, বরিন্ড অঞ্চলে সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার ফাউন্ডেশনের কর্মশালায় সহযোগিতামূলক অভিযোজন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো লবণ-সহনশীল ফসল, উন্নত সেচ এবং রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে কৃষকদের সাহায্য করছে।

অবকাঠামো উন্নয়নে সহনশীলতা

অবকাঠামো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম প্রহরী। ADB-এর কোস্টাল ক্লাইমেট-রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোজেক্ট (CCRIP) ১২টি উপকূলীয় জেলায় বাঁধ, রাস্তা এবং জল সরবরাহ উন্নত করেছে। এতে ১৫৯ কিমি উপজেলা রাস্তা, ১৭৮ কিমি ইউনিয়ন রাস্তা এবং ৩৭৩ কিমি গ্রামীণ রাস্তা আপগ্রেড হয়েছে, যা তাপমাত্রা পরিবর্তন, লবণাক্ততা এবং বন্যার মোকাবিলায় ডিজাইন করা। ১২টি নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ এবং ১০টি রেনোভেশন হয়েছে, যা বন্যার সময় উঁচু স্থান প্রদান করে।

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার মেইনস্ট্রিমিং (CRIM) প্রোজেক্ট ভোলা, বরগুনা এবং সাতক্ষীরায় ৪৫টি নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ এবং ২০টি রেনোভ করছে। এগুলো স্কুল হিসেবে কাজ করে ১৮,৫৯০ শিশুকে শিক্ষা প্রদান করে। ৮০ কিমি অ্যাক্সেস রাস্তা উন্নত করে চরম আবহাওয়ায় যোগাযোগ নিশ্চিত হয়েছে। সাতক্ষীরা শহরে পাইলট উর্বান প্রোজেক্ট ড্রেনেজ, বন্যা সুরক্ষা এবং জল সরবরাহ উন্নত করছে।

IFAD-এর CRALEP প্রোজেক্ট (২০২৫-এ অনুমোদিত, ৭০ মিলিয়ন ডলার) হাওর এবং হাই বরিন্ড অঞ্চলে ৩৩৪ কিমি সহনশীল গ্রামীণ রাস্তা এবং ৫৮টি রুরাল মার্কেট নির্মাণ করবে। ২৪০ গ্রামে ওয়াকওয়ে, টিউবওয়েল এবং স্যানিটেশন সুবিধা স্থাপন হবে। ফ্ল্যাশ ফ্লাড এবং খরার প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা (CReLIC) চালু করে সম্প্রদায়-ভিত্তিক প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করবে। এটি ১.৩৪ মিলিয়ন মানুষকে উপকৃত করবে, যার মধ্যে ৩৪,০০০ যুবককে ভোকেশনাল ট্রেনিং এবং ১০,০০০কে উদ্যোক্তা সাপোর্ট দেবে।

উর্বান এলাকায় পার্টনার্স ফর ওয়াটারের ইনিশিয়েটিভ বন্যা সহনশীল অবকাঠামো তৈরি করছে, যেমন জল চিকিত্সা প্ল্যান্ট এবং ইরিগেশন ড্রেন। সরঙ্কহোলায় UNDP-এর সোলার-পাওয়ার্ড ইরিগেশন এবং ক্যানাল রিপেয়ার প্রোজেক্ট (৩ মিলিয়ন টাকা) ৬৫ কৃষককে ২০ একর জমিতে উৎপাদন বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশে জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তির ব্যবহার

শিক্ষা এবং সমাজে সহনশীলতার একীকরণ

শিক্ষা জলবায়ু সচেতনতার ভিত্তি। UNESCO-এর ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন সিস্টেমস ইনিশিয়েটিভ (CSESI), ২০২৫ সালের জুলাই মাসে লঞ্চ হয়েছে, শিক্ষা সেক্টরে সহনশীলতা মেইনস্ট্রিম করছে। এটি ১৮ মাসের প্রোগ্রাম, যা জাতীয় জলবায়ু ঝুঁকি বিশ্লেষণ, কো-অর্ডিনেশন মেকানিজম এবং ক্লাইমেট ফাইন্যান্স সুরক্ষা করে। প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি লেভেলে ডেটা সংগ্রহ টুলে জলবায়ু উপাদান যোগ করা হয়েছে। ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন ফ্রেমওয়ার্ক আপডেট এবং টিচার ট্রেনিং কারিকুলাম রিভিউ করা হয়েছে। গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (GPE)-এর ফান্ডিংয়ে এটি সম্প্রদায়কে সচেতন করে তুলছে।

মহিলাদের নেতৃত্বে গ্রিন রোড প্রোজেক্টে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে মহিলা গ্রুপগুলো রোড ডিজাইনে অংশ নিচ্ছে। উইমেন্স অ্যাডাপটেশন ল্যাবসের মাধ্যমে জল ব্যবস্থাপনা উন্নত হচ্ছে। এছাড়া, ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট মাইগ্রান্ট ফ্রেন্ডলি টাউন (CRMFT) প্রোজেক্ট (২০২৩-২০২৫) লোকালি লেড অ্যাডাপটেশনের মাধ্যমে স্থানান্তরকারীদের সুরক্ষা করছে।

জীবিকা উন্নয়ন এবং অন্যান্য খাত

CRID প্রোগ্রাম (সাবপ্রোগ্রাম ২) কৃষি, জলসম্পদ, উপকূলীয় এবং খরা-প্রবণ এলাকায় অভিযোজন শক্তিশালী করছে। ৪০০ মিলিয়ন ডলার লোন ADB থেকে এসেছে, যা নীতি সংস্কার এবং ফাইন্যান্স মোবিলাইজ করে। হাওর এরিয়া মাস্টার প্ল্যান বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং উপকূলীয় ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে।

সম্প্রদায়-ভিত্তিক সমাধান যেমন লোকাল গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট (LGED)-এর সাথে UNDP-এর সহযোগিতায় কালভার্ট, কংক্রিট রোড এবং ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ হয়েছে। এটি শরণখোলায় জীবিকা পুনরুদ্ধার করেছে।

চ্যালেঞ্জসমূহ

যদিও অগ্রগতি হয়েছে, চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অপর্যাপ্ত ফান্ডিং, প্রযুক্তির অ্যাক্সেস অভাব এবং জ্ঞানের ঘাটতি। IMF-এর মতে, নীতি ফ্রেমওয়ার্ক শক্তিশালী কিন্তু বাস্তবায়ন দুর্বল। ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং উচ্চ খরচও বাধা।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

২০৩০ সালের মধ্যে ডিজিটালাইজেশন, বিগ ডেটা এবং AI-এর মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সম্ভব। কোপ৩০-এ বাংলাদেশের নীতি এই দিকে ফোকাস করবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়লে টেকসইতা নিশ্চিত হবে।

উপসংহার

জলবায়ু সহনশীল প্রযুক্তি বাংলাদেশকে বিপদের মুখোমুখি করে না, বরং সুযোগে রূপান্তরিত করছে। সকলের সহযোগিতায় আমরা একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।

মন্তব্যসমূহ
* ইমেইলটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে না।