27 Jul
27Jul

ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০২৫ সালে হেলথ টেক উদ্যোগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার, গুণগত মান এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই উদ্যোগগুলো ডিজিটাল হেলথ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), টেলিমেডিসিন এবং ডেটা-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার উপর জোর দিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনে অবদান রাখছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই উদ্যোগগুলো স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। এই ব্লগে আমরা জাতিসংঘ ও WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করব এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করব।

জাতিসংঘ ও WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগ: একটি ওভারভিউ

জাতিসংঘ এবং WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগগুলো মূলত জনস্বাস্থ্যের উন্নতি এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা (Universal Health Coverage) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এই উদ্যোগগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হলো প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং দক্ষ করে তোলা। WHO-এর গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি অন ডিজিটাল হেলথ (২০২০-২০২৫) এই কার্যক্রমের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। এই কৌশলটি ১৯৪টি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে ডিজিটাল হেলথ ইকোসিস্টেম তৈরির উপর জোর দিয়েছে।

প্রধান হেলথ টেক উদ্যোগ

১. ডিজিটাল হেলথ ইনোভেশন

ডিজিটাল হেলথ প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। WHO এবং জাতিসংঘ মোবাইল হেলথ অ্যাপ, ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড (EHR), এবং টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান উন্নত করছে। উদাহরণস্বরূপ, WHO-এর ডিজিটাল হেলথ ইনিশিয়েটিভ দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। বাংলাদেশে, এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি (২০২৩-এ শুরু) ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন এবং ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যা জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক।

২. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং হেলথ টেক

AI-ভিত্তিক প্রযুক্তি স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটাচ্ছে। WHO-এর AI for Health ইনিশিয়েটিভ রোগ নির্ণয়ে নির্ভুলতা বাড়ানো, ওষুধ আবিষ্কার ত্বরান্বিত করা এবং রোগীর ডেটা বিশ্লেষণে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, AI-ভিত্তিক চিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে ক্যানসার সনাক্তকরণ এবং মহামারী প্রকোপ ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হচ্ছে। WHO এই প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে, AI-এর মাধ্যমে ডেঙ্গু এবং যক্ষ্মার মতো রোগের প্রাথমিক সনাক্তকরণে সম্ভাবনা রয়েছে।

৩. টেলিমেডিসিন এবং রিমোট হেলথ সার্ভিস

টেলিমেডিসিন দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। WHO এবং জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টেলিমেডিসিন প্ল্যাটফর্ম উন্নয়নে কাজ করছে। বাংলাদেশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিমেডিসিন প্রোগ্রাম WHO-এর সমর্থনে পরিচালিত হচ্ছে, যা গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসা সেবা প্রদানে সহায়ক।

৪. ডেটা-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা

WHO-এর গ্লোবাল হেলথ অবজারভেটরি রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মহামারী প্রতিক্রিয়া এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় WHO-এর ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড বিশ্বব্যাপী কেস ট্র্যাকিংয়ে সহায়ক ছিল। বাংলাদেশে, ডেঙ্গু মহামারী নিয়ন্ত্রণে WHO-এর ডেটা-ভিত্তিক ট্র্যাকিং সিস্টেম স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।

বাংলাদেশে জাতিসংঘ ও WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগ

বাংলাদেশে জাতিসংঘ এবং WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগগুলো স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই উদ্যোগগুলো মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু হ্রাস এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের বিবরণ দেওয়া হলো:

১. এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি

২০২৩ সালে WHO, ইউনিসেফ, এবং গ্যাভি (ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স)-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশে এইচপিভি টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ২০২৫ সালে এই কর্মসূচি সারাদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে, যা ১০-১৪ বছর বয়সী এক কোটির বেশি মেয়েকে বিনামূল্যে টিকা প্রদানের লক্ষ্য নিয়েছে। এই কর্মসূচি ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যা টিকাদানের দক্ষতা বাড়িয়েছে।

২. টেলিমেডিসিন সেবা সম্প্রসারণ

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় টেলিমেডিসিন সেবা সম্প্রসারণে WHO এবং জাতিসংঘ স্থানীয় এনজিও এবং সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিমেডিসিন প্রোগ্রাম এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৬২৬৩ হেল্পলাইন এই উদ্যোগের ফল। এই সেবাগুলো গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ প্রদানে সহায়ক।

৩. স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ

WHO এবং জাতিসংঘ স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের ডিজিটাল হেলথ টুল এবং AI-এর উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে টিকা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণে WHO-এর সহযোগিতা রয়েছে। এই প্রশিক্ষণ স্বাস্থ্যকর্মীদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে দক্ষ করে তুলছে।

৪. ডেটা-ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা

WHO-এর ডেটা কোয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট টুল এবং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ডেটা ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এই টুলগুলো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ডেটা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, ডেঙ্গু মহামারী নিয়ন্ত্রণে ডেটা-ভিত্তিক ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাংলাদেশে হেলথ টেকের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে হেলথ টেক উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা: গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব টেলিমেডিসিন এবং ডিজিটাল হেলথ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা।
  • দক্ষতার ঘাটতি: AI এবং ডেটা বিশ্লেষণে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে।
  • নৈতিক উদ্বেগ: AI এবং ডেটা ব্যবহারে গোপনীয়তা এবং নৈতিকতার বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন।
  • অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা: হেলথ টেক প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব।
জাতিসংঘ ও WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগের ব্যানার চিত্র, ডিজিটাল স্বাস্থ্য ও AI প্রযুক্তির প্রতিনিধিত্ব

বাংলাদেশে হেলথ টেকের সম্ভাবনা

বাংলাদেশে হেলথ টেকের সম্ভাবনা অপার। জাতিসংঘ এবং WHO-এর উদ্যোগগুলো স্থানীয় উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। নিচে কয়েকটি সম্ভাবনা উল্লেখ করা হলো:

  • স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা AI-ভিত্তিক ডায়াগনস্টিক স্টার্টআপ তৈরি করে WHO-এর গ্লোবাল প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ডেঙ্গু এবং যক্ষ্মার প্রাথমিক সনাক্তকরণে AI-ভিত্তিক অ্যাপ তৈরি করা যেতে পারে।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: WHO এবং জাতিসংঘের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং অর্থায়নের সুযোগ রয়েছে।
  • স্থানীয় সমাধান: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন—ডেঙ্গু, যক্ষ্মা, এবং জরায়ুমুখ ক্যানসারের সমাধানে হেলথ টেক ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: বায়োইনফরমেটিক্স, AI, এবং ডেটা বিশ্লেষণে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তরুণরা হেলথ টেক শিল্পে অবদান রাখতে পারেন।

উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ

বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা জাতিসংঘ এবং WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে নিম্নলিখিত পরামর্শগুলো অনুসরণ করতে পারেন:

  1. স্থানীয় সমস্যার উপর ফোকাস: ডেঙ্গু, যক্ষ্মা, এবং মাতৃস্বাস্থ্যের মতো স্থানীয় সমস্যার সমাধানে হেলথ টেক স্টার্টআপ তৈরি করুন।
  2. WHO-এর গাইডলাইন অনুসরণ: WHO-এর ডিজিটাল হেলথ এবং AI গাইডলাইন অনুসরণ করে নৈতিক ও কার্যকর সমাধান তৈরি করুন।
  3. অর্থায়নের সুযোগ: জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচী (UNDP) এবং WHO-এর গ্রান্ট এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালের জন্য আবেদন করুন।
  4. প্রশিক্ষণ গ্রহণ: AI, বায়োইনফরমেটিক্স, এবং ডেটা বিশ্লেষণে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দক্ষতা বৃদ্ধি করুন।
  5. স্থানীয় অংশীদারিত্ব: স্থানীয় এনজিও এবং সরকারি সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্ব তৈরি করুন।

WHO এবং জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

২০২৫ সালে WHO এবং জাতিসংঘ তাদের হেলথ টেক উদ্যোগ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • গ্লোবাল ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম: WHO একটি গ্লোবাল ডিজিটাল হেলথ প্ল্যাটফর্ম তৈরির পরিকল্পনা করছে, যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ডেটা শেয়ারিং এবং বিশ্লেষণে সহায়ক হবে।
  • AI-এর নৈতিক ব্যবহার: AI-এর নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে।
  • টেলিমেডিসিন সম্প্রসারণ: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হবে।
  • দক্ষতা উন্নয়ন: স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ডিজিটাল হেলথ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা হবে।

উপসংহার

জাতিসংঘ এবং WHO-এর হেলথ টেক উদ্যোগ ২০২৫ সালে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। ডিজিটাল হেলথ, AI, এবং টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার প্রবেশাধিকার ও গুণগত মান বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এই উদ্যোগগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে স্থানীয় সমস্যার সমাধানে অবদান রাখতে পারেন। WHO এবং জাতিসংঘের সমর্থনে হেলথ টেক স্টার্টআপ এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণরা এই শিল্পে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে সক্ষম।


আপনার মতামত জানান

বাংলাদেশে হেলথ টেক উদ্যোগ নিয়ে আপনার কী পরামর্শ? কীভাবে উদ্যোক্তারা এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন? আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের জানান!

মন্তব্যসমূহ
* ইমেইলটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে না।