জিওথার্মাল শক্তি, যা ভূ-তাপীয় শক্তি নামেও পরিচিত, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ থেকে উদ্ভূত একটি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎস। "জিও" শব্দটি গ্রিক ভাষা থেকে এসেছে যার অর্থ পৃথিবী, এবং "থার্মাল" অর্থ তাপ। অর্থাৎ, এটি পৃথিবীর তাপ। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে তাপমাত্রা প্রায় ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার সমান। এই তাপ পৃথিবীর গঠনকালীন অবশিষ্ট তাপ, রেডিওঅ্যাকটিভ ক্ষয় এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসে। জিওথার্মাল শক্তি এই তাপকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, গরমকরণ এবং শীতলকরণের জন্য ব্যবহার করা হয়।
আধুনিক বিশ্বে জ্বালানি সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির চাহিদা বাড়ছে। সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি এবং হাইড্রোপাওয়ারের পাশাপাশি জিওথার্মাল শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি নির্ভরযোগ্য, পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদী। কিন্তু এর কার্যকারিতা কতটা? এই নিবন্ধে আমরা জিওথার্মাল শক্তির সংজ্ঞা, কার্যপ্রণালী, কার্যকারিতা, সুবিধা এবং অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
জিওথার্মাল শক্তির কার্যপ্রণালী পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপের উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে গরম পানির জলাধার বা গরম শিলা থাকে, যা ভূ-তাপীয় জলাধার নামে পরিচিত। এই তাপকে নিষ্কাশন করার জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
প্রধানত তিনটি ধরনের জিওথার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে:
১. ড্রাই স্টিম প্ল্যান্ট: এখানে ভূগর্ভ থেকে সরাসরি বাষ্প নিষ্কাশন করা হয়, যা টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এটি সবচেয়ে সহজ প্রক্রিয়া, কিন্তু এমন এলাকায় সম্ভব যেখানে বাষ্প স্বাভাবিকভাবে উপলব্ধ। উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফর্নিয়ার দ্য গাইজার্স।
২. ফ্ল্যাশ স্টিম প্ল্যান্ট: উচ্চ চাপের গরম পানি ভূগর্ভ থেকে নিষ্কাশন করা হয়। চাপ কমলে পানি বাষ্পে পরিণত হয়, যা টারবাইন চালায়। অবশিষ্ট পানি পুনরায় ভূগর্ভে প্রেরণ করা হয়। এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরন।
৩. বাইনারি সাইকেল প্ল্যান্ট: নিম্ন তাপমাত্রার পানি (১০০-২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ব্যবহার করা হয়। গরম পানি একটি সেকেন্ডারি তরল (যেমন আইসোবুটেন) গরম করে, যা বাষ্পে পরিণত হয়ে টারবাইন চালায়। এটি আরও বিস্তৃত এলাকায় ব্যবহারযোগ্য।
এছাড়া, এনহ্যান্সড জিওথার্মাল সিস্টেম (ইজিএস) নামে একটি উন্নত প্রযুক্তি রয়েছে, যেখানে শুষ্ক শিলায় পানি ইনজেক্ট করে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করা হয়। এটি জিওথার্মাল শক্তিকে আরও বিস্তৃত করে তোলে।
গৃহস্থালী স্তরে, জিওথার্মাল হিট পাম্প ব্যবহার করা হয়। এটি পৃথিবীর স্থির তাপমাত্রা (প্রায় ১০-১৫ ডিগ্রি) ব্যবহার করে ঘর গরম বা ঠান্ডা করে। এটি বিদ্যুৎ খরচ কমায় এবং ৩০০-৫০০% কার্যকারিতা প্রদান করে।
জিওথার্মাল শক্তি অত্যন্ত কার্যকর, বিশেষ করে নির্ভরযোগ্যতা এবং দক্ষতার দিক থেকে। এর ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর ৭০-৯০%, যা সৌর (২৫%) বা বায়ু (৩৫%) শক্তির চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ, এটি সারা বছর ধরে স্থিরভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে, আবহাওয়া বা দিন-রাতের উপর নির্ভর করে না।
দক্ষতার দিক থেকে, জিওথার্মাল প্ল্যান্টের কনভার্সন দক্ষতা ৯০% পর্যন্ত হতে পারে, যা কয়লা বা গ্যাস প্ল্যান্টের (৩০-৪০%) চেয়ে অনেক বেশি। গ্লোবালভাবে, ২০২৫ সাল পর্যন্ত জিওথার্মাল থেকে প্রায় ১৭ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, যা মূলত আইসল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস এবং নিউজিল্যান্ডে। আইসল্যান্ডে ৯০% গরমকরণ জিওথার্মাল থেকে আসে।কিন্তু কার্যকারিতা স্থানভিত্তিক।
শুধুমাত্র ভূ-তাপীয় সক্রিয় এলাকায় (যেমন রিং অফ ফায়ার) এটি সহজলভ্য। উন্নত প্রযুক্তি যেমন ইজিএস এটিকে বিস্তৃত করতে পারে, কিন্তু খরচ বেশি। পরিবেশগত দিক থেকে, এটি কার্বন নিঃসরণ কম (প্রতি কিলোওয়াট-আওয়ারে ৩৮ গ্রাম CO2, কয়লার ৮২০ গ্রামের তুলনায়)। তবে, কিছু প্ল্যান্টে সালফার ডাইঅক্সাইড বা মিথেন নিঃসরণ হতে পারে।
জিওথার্মাল শক্তির অনেক সুবিধা রয়েছে, যা এটিকে একটি আকর্ষণীয় বিকল্প করে তোলে:
১. পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং টেকসই: পৃথিবীর তাপ অক্ষয়, এটি ৫ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত থাকবে। পানি পুনরায় ইনজেক্ট করে জলাধার টেকসই রাখা যায়।
২. নিম্ন কার্বন ফুটপ্রিন্ট: এটি পরিষ্কার শক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সাহায্য করে।
৩. নির্ভরযোগ্যতা: ২৪/৭ সরবরাহ, বেসলোড পাওয়ার হিসেবে আদর্শ।
৪. কম জমি ব্যবহার: একটি প্ল্যান্টের জন্য খুব কম জমি লাগে (সৌরের চেয়ে ১২ গুণ কম)।
৫. উচ্চ দক্ষতা: হিট পাম্পে ৪০০% দক্ষতা, খরচ সাশ্রয়ী।
৬. অর্থনৈতিক সুবিধা: দীর্ঘমেয়াদী (৫০-১০০ বছর) এবং চাকরি সৃষ্টি করে।
তবে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
১. স্থানভিত্তিক: শুধুমাত্র নির্দিষ্ট এলাকায় উপলব্ধ, যা বিশ্বের মাত্র ১০% এলাকা।
২. উচ্চ প্রাথমিক খরচ: খনন এবং প্ল্যান্ট নির্মাণে ২-৭ মিলিয়ন ডলার প্রতি মেগাওয়াট।
৩. পরিবেশগত প্রভাব: খননের কারণে ভূমিকম্প হতে পারে, পানি দূষণ বা ভূমি ধস।
৪. পানি ব্যবহার: অনেক পানি লাগে, যা শুষ্ক এলাকায় সমস্যা।
৫. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: ইজিএস এখনও পরীক্ষামূলক।
যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৭ গিগাওয়াট ক্যাপাসিটি রয়েছে, আইসল্যান্ডে এটি ৩০% বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ইন্দোনেশিয়ায় বিশাল সম্ভাবনা। বাংলাদেশে, যদিও ভূ-তাপীয় সক্রিয়তা কম, উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব।
২০৫০ সালের মধ্যে জিওথার্মাল ৮০০ গিগাওয়াটে পৌঁছাতে পারে, যদি ইজিএস বিকশিত হয়। এটি নেট-জিরো লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে।
জিওথার্মাল শক্তি একটি শক্তিশালী, কার্যকর উৎস, যা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ভবিষ্যৎ। সুবিধা অসুবিধার ভারসাম্য রক্ষা করে এটিকে ব্যবহার করলে বিশ্ব উপকৃত হবে