10 Oct
10Oct

ভূমিকা

জলবায়ু পরিবর্তন আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, চরম আবহাওয়া ঘটনা—এসবের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG), বিশেষ করে SDG 13 (জলবায়ু কর্মসূচি), এই সমস্যা মোকাবিলায় গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে। এখানেই AI (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং Big Data-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রযুক্তিগুলো বিপুল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং পূর্বাভাসের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করছে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিপথ বোঝার এবং মোকাবিলার কৌশলে।

Big Data বলতে বোঝায় এমন ডেটা যা পরিমাণে বিশাল (volume), গতিতে দ্রুত (velocity), বিভিন্ন ধরনের (variety), সত্যতা যাচাইয়ের প্রয়োজন (veracity) এবং মূল্যবান (value)। উদাহরণস্বরূপ, স্যাটেলাইট চিত্র, সেন্সর নেটওয়ার্ক, সোশ্যাল মিডিয়া—এসব থেকে প্রতিদিন জেনারেট হয় যে পরিমাণ ডেটা, তা ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। AI, বিশেষ করে মেশিন লার্নিং (ML), এই ডেটা থেকে প্যাটার্ন চিহ্নিত করে ভবিষ্যতের অনুমান করে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা (IEA)-এর মতে, AI-এর মাধ্যমে ২০৩৫ সালের মধ্যে ১,৪০০ মিলিয়ন টন CO₂ নির্গমন কমানো সম্ভব, যা ডেটা সেন্টারের নির্গমনের তিনগুণ।

এই পোস্টে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব Big Data এবং AI-এর জলবায়ু গবেষণায় প্রয়োগ, উদাহরণ, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যত। এটি গবেষক, নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য উপযোগী হবে।

Big Data জলবায়ু গবেষণায়: মৌলিক প্রয়োগ

Big Data জলবায়ু গবেষণার ভিত্তি। এটি পরিবেশগত পরিবর্তনের রিয়েল-টাইম মনিটরিং, ট্রেন্ড পূর্বাভাস এবং কনজারভেশন অপটিমাইজেশন করে। উদাহরণস্বরূপ, স্যাটেলাইট ইমেজারি থেকে ডেটা বিশ্লেষণ করে বন উজাড়ের প্যাটার্ন চিহ্নিত করা যায়, যা কনজারভেশন প্রকল্পের জন্য অপরিহার্য। EcoMatcher-এর মতে, Big Data গাছ লাগানোর মতো প্রকল্পে সর্বোচ্চ প্রভাবের জন্য অবস্থান নির্ধারণ করে।

জলবায়ু মডেলিংয়ে Big Data-এর ভূমিকা অসাধারণ। Coupled Model Intercomparison Project Phase 6 (CMIP6) এর মতো প্রকল্পে বিপুল ডেটা ব্যবহার করে পরীক্ষামূলক ডিজাইন করা হয়। এটি তাপমাত্রা পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং চরম আবহাওয়ার মডেল তৈরি করে। IBM-এর Environmental Intelligence Suite এর মতো টুল হারিকেন, বন্যা এবং দাবানলের পূর্বাভাস দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে।

কৃষি খাতে Big Data জলবায়ু-স্মার্ট কৃষিকে প্রোত্সাহিত করে। মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং ফসলের স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ করে ফলন পূর্বাভাস দেওয়া যায়। Climate Corporation-এর Climate FieldView প্ল্যাটফর্ম জল ব্যবহার অপটিমাইজ করে বর্জ্য কমায়। এছাড়া, NASA-এর Globe Observer-এর মতো সিটিজেন সায়েন্স প্রকল্পে জনগণের অংশগ্রহণে ডেটা সংগ্রহ হয়, যা গবেষণাকে আরও সমৃদ্ধ করে।

AI-এর ভূমিকা: স্মার্ট বিশ্লেষণ এবং পূর্বাভাস

AI জলবায়ু গবেষণাকে স্মার্ট করে তোলে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম যেমন নিউরাল নেটওয়ার্ক (ANN) এবং সাপোর্ট ভেক্টর মেশিন (SVM) ডেটা থেকে প্যাটার্ন চিহ্নিত করে। উদাহরণস্বরূপ, Stanford-এর গবেষণায় AI গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সাথে তাপপ্রবাহ যুক্ত করে, যা ২০৩০-এর দশকে ১.৫ ডিগ্রি অতিক্রমের পূর্বাভাস দেয়।

IEA-এর রিপোর্ট অনুসারে, AI শক্তি খাতে নির্গমন কমায়। তেল-গ্যাসে মিথেন লিক সনাক্তকরণ, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরিবহনে রুট অপটিমাইজেশন—এসব ৫-১০% দক্ষতা বাড়ায়। ভবনে HVAC সিস্টেম কন্ট্রোল করে ১০% শক্তি সাশ্রয় হয়।

World Economic Forum-এর মতে, AI-এর পাঁচটি মূল প্রভাব ক্ষেত্র: জটিল সিস্টেম রূপান্তর (যেমন DeepMind-এর উইন্ড এনার্জি অপটিমাইজেশন ২০% মূল্য বৃদ্ধি), আবিষ্কার ত্বরান্বিতকরণ (AlphaFold প্রোটিন স্ট্রাকচার ডিকোড করে), আচরণগত পরিবর্তন (Google Maps-এর ইকো-রুটিং ১ মিলিয়ন টন CO₂ কমায়), মডেলিং উন্নয়ন (IceNet ফ্লাড ওয়ার্নিং) এবং অভিযোজন (ড্রট ফরকাস্টিং)।

জলবায়ু গবেষণায় AI ও Big Data

AI এবং Big Data-এর একত্রিত ব্যবহার: সিনার্জি

AI এবং Big Data একত্রে ব্যবহার হলে 'সিস্টেম অফ সিস্টেমস' (SoS) ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি হয়, যা জলবায়ু গবেষণাকে আন্তঃশৃঙ্খলী করে। Frontiers-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৪২টি নিবন্ধের মেটা-অ্যানালাইসিসে সাতটি ক্লাস্টার চিহ্নিত হয়েছে, যেমন AI/ML অপটিমাইজেশন এবং IoT কৃষিতে।

কৃষিতে, ANN হাইড্রোক্লাইমাটোলজি বিশ্লেষণ করে বন্যা ফ্রিকোয়েন্সি পূর্বাভাস দেয়। অ্যাসোসিয়েশন রুল মাইনিং রেইনফলের প্রভাবে ধানের ফলন মূল্যায়ন করে। জলবায়ু মডেলিংয়ে, AI HadCRUT4 ডেটাসেট এক্সটেন্ড করে অবজারভেশনাল গ্যাপ পূরণ করে। ক্লাস্টারিং টেকনিক ইউরোপকে তাপমাত্রা-বৃষ্টিপাত ভিত্তিতে রিজিওনালাইজ করে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়, SVM শহুরে বন্যা ম্যাপ করে। PCA ৩১টি ইন্ডিকেটর দিয়ে উপকূলীয় ভালনারেবিলিটি মূল্যায়ন করে, যেমন বাংলাদেশে। টেকসই শহরে, ML লো-কার্বন প্ল্যানিং করে, IoT সোলার এনার্জি পূর্বাভাস দেয়।

জীববৈচিত্র্যে, ফ্রিকোয়েন্ট আইটেমসেট মাইনিং স্যাটেলাইট ডেটা থেকে ডিফরেস্টেশন প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে। SOM অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যানোমালি ভিজ্যুয়ালাইজ করে।

বাস্তব উদাহরণসমূহ

১. গুগলের প্রজেক্ট সানরুফ: Big Data বিল্ডিং-ভিত্তিক সোলার এনার্জি পটেনশিয়াল মূল্যায়ন করে, কার্বন নির্গমন কমায়।

২. DeepMind-এর AlphaFold: প্রোটিন স্ট্রাকচার ডিকোড করে অলটারনেটিভ প্রোটিন এবং এনার্জি স্টোরেজ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।

৩. টেসলার অপটিকাস্টার: Big Data ডিস্ট্রিবিউটেড এনার্জি রিসোর্স ম্যানেজ করে স্মার্ট গ্রিডে টেকসইতা বাড়ায়।

৪. আইসনেট এবং গুগল ফ্লাডহাব: AI ফ্লাড এবং সি আইস চেঞ্জের আর্লি ওয়ার্নিং দেয়।

৫. মাইক্রোসফটের AI ফর আর্থ: Big Data প্রকল্পে জীববৈচিত্র্য মনিটরিং করে।বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, AI এবং Big Data বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাসে ব্যবহৃত হয়, যা কৃষি এবং উপকূলীয় সুরক্ষায় সাহায্য করে।

চ্যালেঞ্জসমূহ

যদিও সম্ভাবনাময়, চ্যালেঞ্জও কম নয়। ডেটা ম্যানেজমেন্টে ৫V চ্যালেঞ্জ (volume, velocity ইত্যাদি) ঐতিহ্যবাহী টুলগুলোকে অক্ষম করে। হেটারোজেনিয়াস ডেটা ইন্টিগ্রেশন কঠিন, যেমন সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্যাটেলাইট ডেটা।

AI-এর নিজস্ব পরিবেশগত প্রভাব উদ্বেগজনক। ডেটা সেন্টারগুলো বিদ্যুৎ খরচ করে, যা ২০৩০-এর মধ্যে CO₂ নির্গমনের ১% হতে পারে। ডেটা প্রাইভেসি, বায়াস (সোশ্যাল ডেটায়) এবং অ্যাক্সেসিবিলিটি সমস্যা রয়েছে। আন্তঃশৃঙ্খলী ইন্টিগ্রেশনের অভাবে সাইলো অ্যাপ্লিকেশন দেখা যায়।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

ভবিষ্যতে, SoS ফ্রেমওয়ার্ক SDG-গুলোকে লিঙ্ক করে, যেমন এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিংকে জল ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত করে। AI ডেকার্বোনাইজেশন এবং সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম অগ্রসর করবে। ওপেন ডেটা এবং সিটিজেন ইনভলভমেন্ট বাড়লে পলিসি সাপোর্ট শক্তিশালী হবে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জনে এটি সহায়ক।

উপসংহার

AI এবং Big Data জলবায়ু গবেষণাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে, যা মিটিগেশন, অ্যাডাপটেশন এবং রেজিলিয়েন্স নিশ্চিত করবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতা দরকার। এই প্রযুক্তি গ্রহকে রক্ষা করার চাবিকাঠি। আরও গবেষণা এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।

মন্তব্যসমূহ
* ইমেইলটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে না।