বিশ্বব্যাপী পরিবহন খাতে একটি নতুন বিপ্লব ঘটছে, যা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রিন হাইওয়ে এমন একটি উদ্যোগ যা ইলেকট্রিক যানবাহন (ইভি) কেন্দ্রিক পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
এই হাইওয়েগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হয়, যা ইলেকট্রিক যানবাহনের জন্য দ্রুত এবং কার্যকর চার্জিং সুবিধা প্রদান করে। এর পাশাপাশি, স্মার্ট টেকনোলজি ব্যবহার করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ রক্ষার দিকে জোর দেওয়া হয়।বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং দ্রুত শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া দেশে গ্রিন হাইওয়ে একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে।
যানজট, বায়ু দূষণ এবং জ্বালানি আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে এই ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুবিধা আনতে পারে। এই লেখায় আমরা গ্রিন হাইওয়ের ধারণা, চার্জিং স্টেশন ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব, বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ঐতিহ্যবাহী পেট্রোল এবং ডিজেল চালিত যানবাহনগুলো পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), নাইট্রোজেন অক্সাইড (NOx) এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তন এবং বায়ু দূষণের প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, যার একটি বড় অংশ যানবাহন নির্গমনের জন্য দায়ী।ইলেকট্রিক যানবাহন (ইভি) এই সমস্যার একটি টেকসই সমাধান। এগুলো শূন্য নির্গমন (zero-emission) যানবাহন, যা বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত হয় এবং জ্বালানির পরিবর্তে ব্যাটারি ব্যবহার করে।
তবে, ইভি-এর ব্যাপক প্রসারের জন্য শুধু যানবাহন তৈরি করাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এখানেই গ্রিন হাইওয়ের গুরুত্ব। গ্রিন হাইওয়ে হলো এমন একটি পরিবহন নেটওয়ার্ক, যেখানে ইভি চার্জিং স্টেশন নিয়মিত বিরতিতে স্থাপন করা হয়, সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় এবং স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রাফিক ও চার্জিং ব্যবস্থাপনা করা হয়।বাংলাদেশে, যেখানে যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, গ্রিন হাইওয়ে প্রতিষ্ঠা জ্বালানি আমদানির ব্যয় কমাতে এবং পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েকে গ্রিন হাইওয়ে হিসেবে রূপান্তর করা যেতে পারে, যেখানে প্রতি ৪০-৫০ কিলোমিটার অন্তর চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হবে।
চার্জিং স্টেশন হলো গ্রিন হাইওয়ের মূল স্তম্ভ। ইলেকট্রিক যানবাহনের দীর্ঘ দূরত্বের যাত্রার জন্য নিরবচ্ছিন্ন চার্জিং সুবিধা অত্যন্ত জরুরি। তবে, কেবল চার্জিং স্টেশন স্থাপনই যথেষ্ট নয়, এর ব্যবস্থাপনা স্মার্ট এবং কার্যকর হতে হবে। চার্জিং স্টেশন ব্যবস্থাপনার মূল উপাদানগুলো হলো:
এই উপাদানগুলো একত্রিত করে একটি কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সকল চার্জিং স্টেশন পর্যবেক্ষণ করা যায়, যা গ্রিন হাইওয়ের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হলেও এর জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বিবেচনায় গ্রিন হাইওয়ে প্রতিষ্ঠার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের ‘ভিশন ২০৪১’ এ ইলেকট্রিক যানবাহনের প্রসার এবং টেকসই উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে ইতিমধ্যে কিছু চার্জিং স্টেশন চালু হয়েছে, তবে হাইওয়ে-ভিত্তিক নেটওয়ার্ক এখনও গড়ে ওঠেনি।উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা-খুলনা হাইওয়েকে গ্রিন হাইওয়ে হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে প্রতি ৪০-৫০ কিলোমিটার অন্তর চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা যেতে পারে, যা লজিস্টিকস খাতের খরচ কমাবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
প্রতিটি স্টেশনে ১০-২০টি চার্জিং পয়েন্ট থাকলে হাজার হাজার যানবাহন সেবা পাবে।অর্থনৈতিকভাবে, গ্রিন হাইওয়ে জ্বালানি আমদানির ব্যয় কমাবে এবং স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াবে। পরিবেশগতভাবে, যদি ২০৩০ সালের মধ্যে ২০% যানবাহন ইলেকট্রিক হয়, তবে CO2 নির্গমন ২৫-৩০% কমতে পারে। এছাড়া, স্থানীয় সৌরশক্তি প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
গ্রিন হাইওয়ে ও চার্জিং স্টেশন ব্যবস্থাপনা চালু করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলোর সমাধানের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন:
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার, বেসরকারি খাত এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রিন হাইওয়ে এবং চার্জিং স্টেশন সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চীনে টেসলা এবং অন্যান্য কোম্পানি হাই-স্পিড চার্জিং স্টেশন নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। জার্মানির অটোবান হাইওয়েতে সৌরশক্তি চালিত চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ভারতে ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষাধিক ইভি চার্জার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।বাংলাদেশ এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, চীনের মতো ইভি আমদানি ও উৎপাদনে সাবসিডি দেওয়া এবং জার্মানির মতো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া।
২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে একটি সম্পূর্ণ গ্রিন হাইওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলে পরিবহন খাত সম্পূর্ণ টেকসই হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে অটোনোমাস ইলেকট্রিক যানবাহন, ওয়্যারলেস চার্জিং এবং স্মার্ট সিটি ইন্টিগ্রেশন এই ব্যবস্থার অংশ হবে। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখবে।
গ্রিন হাইওয়ে এবং চার্জিং স্টেশন ব্যবস্থাপনা কেবল একটি পরিবহন ব্যবস্থা নয়, এটি একটি টেকসই জীবনধারার প্রতীক। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা চালু করতে সরকার, বেসরকারি খাত এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। একটি সবুজ ভবিষ্যতের জন্য আমরা সকলে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি।