আজকের যুগে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের মুখোমুখি হয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় মহাকাশ গবেষণার প্রযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্যাটেলাইট, রিমোট সেন্সিং, এআই-সমর্থিত সিস্টেম এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো রিয়েল-টাইমে মনিটর করতে পারছি, দুর্যোগ পূর্বাভাস দিতে পারছি এবং টেকসই সমাধান খুঁজে পাচ্ছি। নাসা, ইএসএ এবং অন্যান্য সংস্থার গবেষণা দেখায় যে, বর্তমানে ১৬০টিরও বেশি স্যাটেলাইট গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সূচকগুলো পরিমাপ করছে, যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জরুরি ক্লাইমেট ভ্যারিয়েবল শুধুমাত্র মহাকাশ থেকে পরিমাপযোগ্য।
এই প্রযুক্তিগুলো শুধু তথ্য সরবরাহ করে না, বরং জলবায়ু চুক্তির মতো আন্তর্জাতিক লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে। এই লেখায় আমরা দেখব কীভাবে মহাকাশ গবেষণা আমাদের গ্রহকে রক্ষা করছে।
মহাকাশ গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো স্যাটেলাইট প্রযুক্তি, যা পৃথিবীর ব্যাপক পরিবর্তনগুলো ট্র্যাক করে। এগুলো ডিফরেস্টেশন, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন, তাপমাত্রা পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মেরু অঞ্চলের বরফ গলার মতো ইস্যু মনিটর করে। উদাহরণস্বরূপ, ক্লাইমেট ট্রেস (Climate TRACE) সংস্থা স্যাটেলাইট ডেটা এবং এআই ব্যবহার করে তেলক্ষেত্র এবং কারখানা থেকে নির্গমন ম্যাপ করে, যা জাতিসংঘের রিপোর্টের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ অনির্দিষ্ট নির্গমন প্রকাশ করে। নাসার স্যাটেলাইট মিথেনের ৫০টিরও বেশি সুপার-ইমিটার চিহ্নিত করেছে, যা কেন্দ্রীয় এশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। এই তথ্যগুলো কার্বন মার্কেট এবং নির্গমন হ্রাসের জন্য অপরিহার্য।
আরেক উদাহরণ হলো নাসার আইস, ক্লাউড অ্যান্ড ল্যান্ড ইলিভেশন স্যাটেলাইট-২ (ICESat-2), যা ২০১৮ সালে লঞ্চ হয়েছে। এটি বরফের পরিবর্তন ৮৫ সেন্টিমিটারের গ্রাউন্ড পাথে পরিমাপ করে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়া পূর্বাভাসে সাহায্য করে। এর পূর্বসূরি গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকার উপকূলীয় বরফের লুপ্তপ্রায় অদৃশ্যতা প্রকাশ করেছে। ডিজিটাল আর্থ আফ্রিকা (Digital Earth Africa) ওপেন ডেটা কিউব এবং অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিস ব্যবহার করে স্যাটেলাইট ডেটা কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়, যা ফসলের উৎপাদন বাড়ায় এবং অবৈধ খনন রোধ করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বছরে গড়ে ৪৫,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটায় এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি করে। ইএসএর (ESA) ডিসকভারি প্রোগ্রাম স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ, ভূমিকম্প, খরা এবং অগ্নিকাণ্ড পূর্বাভাস করে। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট মারাপির টেকটোনিক প্রক্রিয়া SAR ইন্টারফেরোমেট্রি (রাডার-ভিত্তিক) এবং গ্লোবাল নেভিগেশন সিস্টেমের মাধ্যমে মনিটর করা হয়, যা ১১ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। কোপারনিকাস সেন্টিনেল-১ ডেটা বালির মাউন্ট আগুঙ্গের চারপাশে মাটির উত্তোলন দেখিয়েছে, যা ম্যাগমা চলাচলের ইঙ্গিত দেয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়েস্টার্ন কেপে খরা-প্রবণ মৌসুমে স্যাটেলাইট অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে। ইউকে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন (UKRI) এবং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফ্যাসিলিটিস কাউন্সিল (STFC)-এর আরএএল স্পেস বিজ্ঞানীরা ২০১৯-২০২০ অস্ট্রেলিয়ান অগ্নিকাণ্ডে সেন্টিনেল ডেটা বিশ্লেষণ করে কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন এবং মিথানলের প্লুম ট্র্যাক করেছে, যা দক্ষিণ গোলার্ধে বায়ুমণ্ডলীয় প্রভাব দেখিয়েছে। এই ডেটা অগ্নিসমূহের বিস্তার এবং নির্গমন ট্র্যাক করে দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করে।
স্যাটেলাইট এবং সেন্সরগুলো বন্যপ্রাণী অপরাধ এবং দূষণ ট্র্যাক করে। আফ্রিকায় রিসলভ (Resolve) এবং ইনমারস্যাটের ট্রেইলগার্ড এআই অ্যান্টি-পোচিং ক্যামেরা সিস্টেম তানজানিয়ার গ্রুমেটি রিজার্ভে ৩০ জন পোচার গ্রেপ্তার করেছে এবং ৫৯০ কিলোগ্রামেরও বেশি বুশমিট জব্দ করেছে। আন্তর্জাতিক কো-অপারেশন ফর অ্যানিমাল রিসার্চ ইউজিং স্পেস (Icarus) উদ্যোগ আইএসএস-এর স্যাটেলাইটে থাম্বনেইল-সাইজড ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে পাখি এবং প্রাণীদের মাইগ্রেশন প্যাটার্ন ট্র্যাক করে, যা "ইন্টারনেট অফ অ্যানিমালস" তৈরি করে।
সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ মনিটরিংয়ে স্যাটেলাইট সারফেস কারেন্ট ম্যাপ করে, যেমন গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচে প্লাস্টিকের ঘনত্ব অনুমান করে। ইএসএর ২০১৯ ওপেন স্পেস ইনোভেশন প্ল্যাটফর্ম (OSIP) কল রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্লাস্টিক সনাক্তকরণের জন্য আইডিয়া ফান্ড করেছে। আরএএল স্পেসের বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে বনের স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করে, যা রোগ-প্রতিরোধী প্রজাতি লাগিয়ে কার্বন শোষণ বাড়ায়।
মহাকাশ গবেষণা ক্লাইমেট মিটিগেশনের উন্নত প্রযুক্তি প্রদান করে। সোলার রেডিয়েশন ম্যানেজমেন্ট (SRM) যেমন স্ট্র্যাটোস্ফেরিক অ্যারোসল ইনজেকশন (SAI) আগ্নেয়গিরির ঠান্ডা প্রভাব অনুকরণ করে সূর্যালোক প্রতিফলিত করে, যা জরুরি অবস্থায় তাপমাত্রা কমাতে পারে। মেরিন ক্লাউড ব্রাইটেনিং (MCB) মেঘের প্রতিফলকতা বাড়ায়। তবে এগুলো নির্গমন কমায় না এবং আবহাওয়া ব্যাহত করতে পারে।
কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ ইন স্পেসে CO₂ চাঁদ বা মঙ্গলে সংরক্ষণ করে, যেখানে ঠান্ডা তাপমাত্রা স্থায়ী ফ্রোজেন রিজার্ভোয়ার তৈরি করে। স্পেস-বেসড সোলার পাওয়ার (SBSP) জিওস্টেশনারি অরবিটে সোলার প্যানেল ব্যবহার করে ২৪/৭ শক্তি উৎপাদন করে, যা মাইক্রোওয়েভ বা লেজার দিয়ে পৃথিবীতে পাঠায়। জ্যাক্সা এবং চীন ২০৩০ সালের মধ্যে অপারেশনাল স্টেশন গড়ার পরিকল্পনা করছে, যা ফসিল ফুয়েল নির্ভরতা কমাবে।
আরএএল স্পেস ১৯৮০-এর দশক থেকে অ্যালং-ট্র্যাক স্ক্যানিং রেডিওমিটার (ATSR) এবং সি অ্যান্ড ল্যান্ড সারফেস টেম্পারেচার রেডিওমিটার (SLSTR) যন্ত্র তৈরি করে সমুদ্র এবং ভূমি তাপমাত্রা ০.২°সে. নির্ভুলতায় পরিমাপ করে, যা প্যারিস চুক্তির জন্য ৪০ বছরের ডেটাসেট তৈরি করেছে।
মহাকাশ অনুসন্ধানের "ওভারভিউ ইফেক্ট" – অ্যাস্ট্রোনটদের পৃথিবীর ভঙ্গুরতা দেখার অভিজ্ঞতা – পরস্পরসংযুক্ত ইকোসিস্টেমের সচেতনতা বাড়ায়। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি এবং শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইন এই প্রভাব অনুকরণ করে জলবায়ু কর্মসূচি উদ্বুদ্ধ করে। নাসার আর্থ সিস্টেম অবজারভেটরি পরবর্তী দশকে লঞ্চ হবে, যা অগ্নিকাণ্ড, সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি এবং আরও মনিটর করবে।
মহাকাশ গবেষণার প্রযুক্তি আমাদের গ্রহকে রক্ষা করার একটি শক্তিশালী অস্ত্র। স্যাটেলাইট থেকে শুরু করে উন্নত মিটিগেশন টুল পর্যন্ত, এগুলো তথ্য, পূর্বাভাস এবং সমাধান প্রদান করে। তবে চ্যালেঞ্জ যেমন খরচ এবং শাসনের প্রয়োজন রয়েছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এই প্রযুক্তিকে আরও কার্যকর করে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারি। আরও গবেষণা এবং বিনিয়োগ এখনই দরকার।