ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ। মানুষের কার্যকলাপ, বিশেষ করে শিল্প এবং পরিবহন খাত থেকে উৎপন্ন CO₂ এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে, বর্তমান হারে চললে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে, যা বন্যা, খরা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো দুর্যোগ ঘটাবে। এই কার্বন নির্গমন কমাতে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি (Carbon Capture Technology) একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে, বাতাস থেকে সরাসরি CO₂ শোষণের ডিরেক্ট এয়ার ক্যাপচার (Direct Air Capture - DAC) প্রযুক্তি এই ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশে, যেখানে বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি উচ্চ, এই প্রযুক্তি টেকসই উন্নয়নের পথ দেখাতে পারে।
এই নিবন্ধে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির বিবর্তন, DAC-এর কার্যপ্রণালী, সুবিধা, চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি কী?
কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি হলো CO₂ এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস শোষণ, সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের প্রক্রিয়া। এটি তিনটি প্রধান ধাপে কাজ করে:
- ক্যাপচার: CO₂ শোষণ।
- ট্রান্সপোর্টেশন: শোষিত CO₂ পরিবহন।
- স্টোরেজ: CO₂ স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ।
কার্বন ক্যাপচারের প্রধান ধরনগুলো হলো:
- পোস্ট-কম্বাস্টন ক্যাপচার: শিল্পে CO₂ উৎপন্নের পর শোষণ।
- প্রি-কম্বাস্টন ক্যাপচার: জ্বালানি জ্বালানোর আগে CO₂ আলাদা করা।
- অক্সি-ফুয়েল কম্বাস্টন: অক্সিজেন-সমৃদ্ধ পরিবেশে জ্বালানি জ্বালিয়ে CO₂ শোষণ।
- ডিরেক্ট এয়ার ক্যাপচার (DAC): বাতাস থেকে সরাসরি CO₂ শোষণ।
DAC বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি যেকোনো স্থান থেকে CO₂ শোষণ করতে পারে এবং বর্তমান নির্গমনের বাইরে অতিরিক্ত CO₂ কমাতে সহায়ক।
DAC-এর কার্যপ্রণালী
DAC বাতাস থেকে CO₂ শোষণের জন্য রাসায়নিক বা শারীরিক শোষক ব্যবহার করে। প্রক্রিয়া:
- শোষণ: বাতাসে CO₂-সমৃদ্ধ রাসায়নিক (যেমন, অ্যামিন) বা সলিড সোর্বেন্ট (যেমন, জিরকোনিয়াম-ভিত্তিক উপাদান) ব্যবহার।
- পুনরুদ্ধার: তাপ বা চাপ পরিবর্তন করে CO₂ আলাদা করা।
- সংরক্ষণ: শোষিত CO₂ ভূগর্ভস্থ সংরক্ষণ বা ব্যবহার (যেমন, ফুয়েল উৎপাদন)।
উদাহরণ: Climeworks-এর Orca প্ল্যান্ট আইসল্যান্ডে বছরে ৪,০০০ টন CO₂ শোষণ করে। Carbon Engineering-এর DAC টেকনোলজি ২০২৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে উপলব্ধ হবে।
কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির সুবিধা
১. কার্বন নির্গমন হ্রাস
- DAC বাতাস থেকে CO₂ শোষণ করে কার্বন সাইকেলে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।
- উদাহরণ: একটি DAC প্ল্যান্ট বছরে ১ মিলিয়ন টন CO₂ শোষণ করতে পারে।
২. টেকসই উন্নয়ন
- কার্বন ক্যাপচার CCS (Carbon Capture and Storage) এবং CCUS (Carbon Capture, Utilization and Storage) এর মাধ্যমে CO₂ সংরক্ষণ বা ব্যবহার (যেমন, ফুয়েল উৎপাদন) সম্ভব।
- উদাহরণ: CO₂ থেকে প্লাস্টিক বা জ্বালানি তৈরি।
৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা
- DAC বাতাসের CO₂ কনসেনট্রেশন কমিয়ে জলবায়ু স্থিতিশীলতা বজায় রাখে।
- উদাহরণ: বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি মোকাবিলায় সহায়ক।
৪. অর্থনৈতিক সুবিধা
- DAC প্ল্যান্ট শক্তি এবং চাকরির সৃষ্টি করে।
- উদাহরণ: ২০২৫ সালে DAC মার্কেট ৬৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
৫. গ্লোবাল লক্ষ্য অর্জন
- প্যারিস চুক্তির ১.৫°C লক্ষ্য অর্জনে DAC অপরিহার্য।
কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ
১. উচ্চ খরচ
- DAC-এর বর্তমান খরচ ২০০-৬০০ ডলার/টন CO₂, যা অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জিং।
- উদাহরণ: Climeworks-এর Orca প্ল্যান্টে খরচ ৬০০ ডলার/টন।
২. শক্তি খরচ
- DAC-এর জন্য বিপুল পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, যা নবায়নযোগ্য শক্তির উপর নির্ভর করে।
- উদাহরণ: ১ টন CO₂ শোষণে ১৫০০ kWh শক্তি লাগে।
৩. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা
- বড় স্কেলে DAC বাস্তবায়ন এখনও পরীক্ষামূলক।
- উদাহরণ: ২০২৫ সালে পাইলট প্রকল্প বাড়লেও ফুল-স্কেল ডেপ্লয়মেন্ট বছর দূরে।
৪. অবকাঠামোর অভাব
- CO₂ স্টোরেজ এবং পরিবহনের জন্য অবকাঠামো প্রয়োজন।
- উদাহরণ: বাংলাদেশে CCS (Carbon Capture and Storage) অবকাঠামো নেই।
৫. জনসচেতনতা এবং নীতি
- প্রযুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা কম।
- উদাহরণ: বাংলাদেশে CCS-এর জন্য নীতিমালা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তির সম্ভাবনা
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। এখানে DAC এবং CCS-এর সম্ভাবনা বিশাল।
১. বাজারের সম্ভাবনা
- বাংলাদেশের শিল্প খাত থেকে বিপুল পরিমাণ CO₂ নির্গত হয়।
- উদাহরণ: সিমেন্ট এবং পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন টন CO₂।
২. চলমান উদ্যোগ
- CCS গবেষণা: BUET এবং SPARRSO-এর গবেষণা।
- পাইলট প্রকল্প: পাওয়ার প্ল্যান্টে CCS পরীক্ষা।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বিশ্বব্যাংক CCS প্রকল্পে তহবিল প্রদান করছে।
৩. সরকারি নীতি
- লক্ষ্যমাত্রা: ২০৩০ সালের মধ্যে ১০% CO₂ ক্যাপচার।
- নীতি: জাতীয় পরিবেশ নীতিতে CCS প্রচার।
৪. অবকাঠামো উন্নয়ন
- গ্যাস ফিল্ডে CO₂ স্টোরেজ।
- উদাহরণ: খালিজন গ্যাস ফিল্ডে CCS সম্ভাবনা।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায়
১. আর্থিক সহায়তা
- আন্তর্জাতিক তহবিল এবং সরকারি ভর্তুকি।
- উদাহরণ: Green Climate Fund থেকে তহবিল।
২. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
- স্থানীয় গবেষণা এবং পাইলট প্রকল্প।
- উদাহরণ: BUET-এর CCS গবেষণা।
৩. জনসচেতনতা
- সামাজিক মাধ্যম এবং প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি।
- অনলাইন শিক্ষা:
- Coursera: Carbon Capture and Storage – সময়কাল: ৪ সপ্তাহ, মূল্য: $49/মাস।
- edX: Climate Mitigation Technologies – সময়কাল: ৬ সপ্তাহ, মূল্য: বিনামূল্যে অডিট।
৪. নীতি প্রণয়ন
- CCS-এর জন্য কঠোর আইন এবং প্রণোদনা।
- উদাহরণ: CO2 মিনারেলাইজেশন প্রচার।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
- IEA এবং UNEP-এর সাথে সহযোগিতা।
- উদাহরণ: CCS-এর সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব গবেষণা।
উপসংহার
কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি, বিশেষ করে বাতাস থেকে CO₂ শোষণের DAC, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অপরিহার্য। ২০২৫ সালে এর উন্নয়ন দ্রুত হচ্ছে, তবে খরচ এবং অবকাঠামোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশে CCS এবং DAC-এর সম্ভাবনা বিশাল, বিশেষ করে গ্যাস ফিল্ড এবং শিল্প খাতে। সঠিক নীতি, বিনিয়োগ এবং গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ এই প্রযুক্তি গ্রহণ করে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে।
আপনার মতামত: বাংলাদেশে কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত? আপনার মূল্যবান মতামত শেয়ার করুন!