জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে, প্রকল্পগুলোর সঠিক পর্যবেক্ষণ এবং যাচাইকরণ অত্যন্ত জরুরি। কার্বন ক্রেডিট, বনায়ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মতো জলবায়ু প্রজেক্টে গ্রিনওয়াশিং (পরিবেশবান্ধবতার ভান) একটি বড় সমস্যা। এখানেই ব্লকচেইন প্রযুক্তির ভূমিকা উঠে আসছে। এই ডিসেন্ট্রালাইজড লেজার সিস্টেম স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, ডেটা ট্যাম্পার-প্রুফ করে এবং রিয়েল-টাইম মনিটরিং সম্ভব করে। ২০২৫ সালে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি অনুসারে, ব্লকচেইন স্মার্ট কনট্রাক্টের মাধ্যমে কার্বন ফুটপ্রিন্টের হিসাব রাখছে এবং ভ্যালু চেইন জুড়ে রিডাকশন ট্র্যাক করছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (WEF)-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ব্লকচেইন রিজেনারেটিভ ফাইন্যান্স (ReFi)-এর মাধ্যমে জলবায়ু অ্যাকশন স্কেল করছে, যা ডেকার্বোনাইজেশন এবং নেট-জিরো লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করছে।
এই লেখায় আমরা দেখব ব্লকচেইন কীভাবে জলবায়ু প্রজেক্ট পর্যবেক্ষণে কাজে লাগছে, উদাহরণসমূহ, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা। এটি গবেষক, নীতিনির্ধারক এবং টেক উত্সাহীদের জন্য উপযোগী।
ব্লকচেইন একটি ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার টেকনোলজি, যা ডেটা ব্লকগুলোতে সংরক্ষণ করে এবং ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশের মাধ্যমে যুক্ত করে। এর অ-কেন্দ্রীয়করণ, ইমিউটেবিলিটি এবং ট্রান্সপারেন্সি জলবায়ু প্রজেক্টের জন্য আদর্শ। ঐতিহ্যবাহী সিস্টেমে ডেটা ম্যানিপুলেশন এবং অস্বচ্ছতা সমস্যা, কিন্তু ব্লকচেইন এগুলো রোধ করে। উদাহরণস্বরূপ, মনিটরিং, রিপোর্টিং এবং ভেরিফিকেশন (MRV) সিস্টেমে ব্লকচেইন ক্লাইমেট ডেটা যেমন কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন, গাছের বৃদ্ধি বা ল্যান্ড হেলথ ট্র্যাক করে।
স্মার্ট কনট্রাক্ট এর একটি মূল অংশ, যা অটোমেটেড এগ্রিমেন্ট যাচাই করে। ওরাকলস (বাহ্যিক ডেটা ফিডার) রিয়েল-ওয়ার্ল্ড ডেটা যেমন আবহাওয়া বা IoT সেন্সর থেকে ইনপুট নিয়ে স্মার্ট কনট্রাক্ট অ্যাকটিভ করে। এটি জলবায়ু প্রজেক্টে অটোমেটেড পেমেন্ট, ভেরিফিকেশন এবং কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করে। ২০২৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, AI-এনহ্যান্সড ব্লকচেইন ফ্রেমওয়ার্ক ক্লাইমেট মনিটরিং এবং কার্বন ক্রেডিট ভেরিফিকেশনে লিমিটেশন অতিক্রম করছে।
কার্বন ক্রেডিট মার্কেটে স্বচ্ছতার অভাব একটি বড় সমস্যা। ব্লকচেইন এটি সমাধান করে টোকেনাইজড অ্যাসেটের মাধ্যমে। Toucan Protocol-এর মতো প্রকল্প ৫০টিরও বেশি ক্লাইমেট প্রজেক্ট থেকে ২৯৭,৫৫৮ টন কার্বন ক্রেডিট রিটায়ার করেছে, যার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার Rimba Raya নেচার রিজার্ভ অন্তর্ভুক্ত। এটি ব্লকচেইন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবহার করে কার্বন অফসেট ট্রান্সফারের ভ্যালিডিটি নিশ্চিত করে।
আরেক উদাহরণ হলো Climate Action Data Trust, যা ফ্র্যাগমেন্টেড কার্বন রেজিস্ট্রিকে ব্লকচেইন-ভিত্তিক সিস্টেমে যুক্ত করে ট্রান্সপারেন্ট ট্রানজেকশন রেকর্ড করে। ২০২৫ সালে, ৬০% নতুন কার্বন ক্রেডিট প্ল্যাটফর্ম কৃষি এবং ফরেস্ট্রিতে ব্লকচেইন ব্যবহার করছে। IBM এবং Energy Blockchain Lab-এর চীনা প্রকল্প কার্বন অ্যাসেট ট্রানজেকশন রেকর্ড করে, যা পাবলিক ব্লকচেইনে স্টোর করে ভ্যালিডিটি বাড়ায়।
B4ECarbon প্রকল্প Hedera নেটওয়ার্কে IoT সেন্সর ইন্টিগ্রেট করে রিয়েল-টাইম এমিশন মনিটরিং করে এবং AI অ্যানালিটিক্স প্রদান করে। এটি এনার্জি সেক্টরে কার্বন রিডাকশন ভেরিফাই করে। Jumbo Blockchain-এর স্মার্ট কার্বন মনিটরিং সিস্টেম IoT সেন্সর থেকে এনার্জি ইউজ এবং এমিশন ডেটা ক্যাপচার করে ট্যাম্পার-প্রুফ রেকর্ড তৈরি করে, যা কার্বন ক্রেডিট ক্লেইম সহজ করে।
রিয়েল-টাইম মনিটরিংয়ে IoT + ব্লকচেইন একটি শক্তিশালী কম্বিনেশন। একটি স্টাডিতে দেখা গেছে, কনসোর্টিয়াম ব্লকচেইন কার্বন ডাই অক্সাইড রিমুভাল (CDR) সিস্টেমে ব্যবহার করে ট্রান্সপারেন্সি এবং ট্রাস্ট বাড়ায়, যা IoT মনিটরিংয়ের সাথে হাইব্রিড ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে। সিমুলেশনে এটি অ্যাডমিন খরচ ২২-৩০% কমায় এবং ডেটা অ্যাকুরেসি ১৫% বাড়ায়।
Camp Network এনার্জি সেক্টরে রিনিউয়েবল সোর্স যেমন সোলার এবং উইন্ডের প্রোডাকশন ডেটা ব্লকচেইনে স্টোর করে কার্বন ফুটপ্রিন্ট ক্যালকুলেশন সঠিক করে। BigWater প্রকল্প প্রতি লিটার জল, পাতা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ডেটা অন-চেইন রেকর্ড করে স্মার্ট কনট্রাক্ট এবং সেন্সর ব্যবহার করে। Thallo এবং EarthSync প্রকল্প ভেরিফাইড অফসেট টোকেনাইজ করে ওয়ালেট-বাউন্ড ক্লেইম এবং অরাকল-ওয়েটেড ইমপ্যাক্ট তৈরি করে।
Mercedes-Benz সাপ্লাই চেইনে ব্লকচেইন ব্যবহার করে ক্লাইমেট-রিলেভেন্ট গ্যাস এমিশন এবং সেকেন্ডারি ম্যাটেরিয়াল ট্র্যাক করে। এটি ব্যাটারি সেল ম্যানুফ্যাকচারারদের জন্য ইমিউটেবল রেকর্ড তৈরি করে।
স্মার্ট কনট্রাক্ট জলবায়ু ঝুঁকি ম্যানেজ করে। Arbol এবং Etherisc-এর মতো প্রকল্প ক্রপ ইনস্যুরেন্স প্রদান করে, যেখানে ফার্মাররা ছোট ফসলের জন্য পলিসি নিয়ে আবহাওয়া কন্ডিশন সেট করে। ওরাকলস আবহাওয়া প্যাটার্ন মনিটর করে অটোমেটিক পেমেন্ট করে। Carbon Risk Crop Insurance ফার্মারদের ক্লাইমেট রিস্ক থেকে সুরক্ষা দেয়।
Terra প্রকল্প ব্লকচেইন ব্যবহার করে রিফরেস্টেশন উত্সাহিত করে। Basin এবং Climate DAO স্মার্ট কনট্রাক্ট ব্যবহার করে কার্বন অফসেট ট্রান্সফারের টার্মস এনফোর্স করে। Solaxy Token ট্রান্সপারেন্ট লেজার তৈরি করে ফান্ড, প্রজেক্ট এবং ইমপ্যাক্ট ট্র্যাক করে গ্রিনওয়াশিং রোধ করে।
গ্রিন হাইড্রোজেন সেক্টরে ব্লকচেইন সাপ্লাই চেইন ট্রেসেবল করে প্রোডাকশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন অপটিমাইজ করে। MCG-এর পার্টনারশিপ ব্লকচেইন ব্যবহার করে হাইড্রোজেন সাপ্লাই চেইন মনিটর করে। Fishcoin সীফুড ট্রেসেবিলিটি প্রমোট করে অবৈধ ফিশিং রোধ করে, যা কার্বন এমিশন কমায়।
গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড ব্লকচেইন ব্যবহার করে ট্রান্সপারেন্ট ট্রানজেকশন এবং মনিটরিং প্রক্রিয়া সহজ করে। OceanDrop NFT প্রকল্প কোস্টা রিকার মেরিন এরিয়ায় কার্বন অফসেটিং ফাইন্যান্স করে। WEF-এর ক্রিপ্টো সাসটেইনেবিলিটি কোলিশন ReFi-এর মাধ্যমে ব্লকচেইন ইন্টিগ্রেট করে ডেকার্বোনাইজেশন প্রমোট করে।
ব্লকচেইনের নিজস্ব পরিবেশগত প্রভাব উদ্বেগজনক। PwC-এর ফ্রেমওয়ার্ক অনুসারে, এর ইলেকট্রিসিটি ইউজ, গ্রিনহাউস গ্যাস এমিশন এবং ই-ওয়েস্ট মাপা হয়। প্রুফ-অফ-ওয়ার্ক মেকানিজম এনার্জি-ইনটেনসিভ, যা বিল গেটসের মতে "ক্লাইমেটের জন্য খারাপ"। তবে, প্রুফ-অফ-স্টেক এবং গ্রিন এনার্জি শিফট এটি মিটিগেট করছে।
স্কেলিং এবং ইন্টারঅপারেবিলিটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। Energy Web Chain এবং Climate Chain Coalition স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন করে ডেটা শেয়ারিং প্রমোট করে। রেগুলেটরি অনিশ্চয়তা এবং ডিজিটাল ডিভাইডও বাধা।
২০২৫ সালের Earth Day প্যানেলে আলোচিত হয়েছে, ব্লকচেইন ক্যাপিটাল ফ্লো ত্বরান্বিত করে ছোট ডেভেলপারদের এমপাওয়ার করে। Flexigrid প্রকল্প রিনিউয়েবল এনার্জি ট্র্যাক করে। ২০৩০ সালের মধ্যে, AI-ব্লকচেইন হাইব্রিড সাসটেইনেবিলিটি ডিসিশন-মেকিং রিফাইন করবে। প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্টের লক্ষ্য অর্জনে এটি অপরিহার্য।
ব্লকচেইন জলবায়ু প্রজেক্ট পর্যবেক্ষণকে বিপ্লবী করে তুলছে, যা স্বচ্ছতা এবং ট্রাস্ট নিয়ে টেকসই অ্যাকশন নিশ্চিত করে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতা দরকার। এই প্রযুক্তি গ্রহকে রক্ষার চাবিকাঠি। আরও ইনোভেশন এবং রেগুলেশনের মাধ্যমে আমরা একটি সবুজ ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।