09 Oct
09Oct

ভূমিকা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা, বন্যা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের সমস্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে, যেখানে বৃষ্টিপাত কৃষি উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি, এই সমস্যা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষতি ঘটাচ্ছে। ত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তি বা ক্লাউড সিডিং (Cloud Seeding) এই সমস্যার সমাধানে একটি উদ্ভাবনী পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। 

এই প্রযুক্তি মেঘের মধ্যে কৃত্রিমভাবে বীজ (Seed) ছড়িয়ে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি করে। ২০২৫ সালে এই প্রযুক্তির উন্নতি এবং ব্যাপক প্রয়োগের সম্ভাবনা বেড়েছে। 

এই নিবন্ধে কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী, সুবিধা, চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তি কী?

কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তি বা ক্লাউড সিডিং হলো এমন একটি আবহাওয়া পরিবর্তন পদ্ধতি, যা মেঘের মধ্যে কৃত্রিমভাবে বীজ (Seed) ছড়িয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই বীজগুলো সাধারণত সিলভার আয়োডাইড (AgI), ড্রাই আইস (CO₂), বা সল্ট (NaCl) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রক্রিয়াটি মেঘের মধ্যে পানির কণা বা বরফের কণা গঠনে সহায়তা করে, যা বৃষ্টির ফোঁটা তৈরি করে। এই প্রযুক্তি ১৯৪০-এর দশকে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খরা মোকাবিলা এবং জলসম্পদ বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়

পরিসংখ্যান

  • বিশ্বব্যাপী: ৫০টির বেশি দেশে ক্লাউড সিডিং প্রোগ্রাম চালু।
  • বাংলাদেশে: বাংলাদেশ আবহাওয়া দফতর (BMD) খরা মোকাবিলায় পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করেছে।

কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তির কার্যপ্রণালী

ক্লাউড সিডিং মেঘের মধ্যে বীজ ছড়িয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিত ধাপে সম্পন্ন হয়:

  1. মেঘ নির্বাচন: রাডার এবং স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে উপযুক্ত মেঘ চিহ্নিত করা হয়।
  2. বীজ ছড়ানো: বিমান, রকেট বা গ্রাউন্ড-ভিত্তিক জেনারেটর থেকে সিলভার আয়োডাইড বা ড্রাই আইস ছড়ানো হয়।
  3. বৃষ্টিপাত গঠন: বীজ মেঘের পানির কণা বা বরফের কণা গঠনে সহায়তা করে, যা বৃষ্টির ফোঁটা তৈরি করে।
  4. পর্যবেক্ষণ: রাডার এবং সেন্সর দিয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিমাপ।

বীজের ধরন

  • সিলভার আয়োডাইড (AgI): বরফের কণা গঠনে সহায়ক, কিন্তু পরিবেশগত উদ্বেগ রয়েছে।
  • ড্রাই আইস (CO₂): দ্রুত বৃষ্টিপাত ঘটায়।
  • সল্ট (NaCl): সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব।

কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তির ইতিহাস

ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তির ইতিহাস ১৯৪০-এর দশকে শুরু। ১৯৪৬ সালে ভিনসেন্ট শেফার এবং বার্নার্ড ভনেগুট সিলভার আয়োডাইড ব্যবহার করে প্রথম সফল পরীক্ষা করেন। ১৯৫০-এর দশকে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হয়। ২০২৫ সালে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হয়েছে, যেমন ড্রোন এবং স্যাটেলাইট-ভিত্তিক বীজ ছড়ানো।

বাংলাদেশে ইতিহাস

বাংলাদেশে ক্লাউড সিডিং ১৯৮০-এর দশকে শুরু, খরা মোকাবিলায় পরীক্ষামূলক প্রকল্প। ২০২৫ সালে BMD এবং SPARRSO এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে।

কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তির সুবিধা

১. খরা মোকাবিলা

  • বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি করে কৃষি উৎপাদন বাড়ায়।
  • উদাহরণ: আরব আমিরাতে ২০২৫ সালে ১৮৫টি মিশন চালিয়ে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি করেছে।

২. জলসম্পদ বৃদ্ধি

  • জলাধার এবং ভূগর্ভস্থ পানি পূরণ।
  • উদাহরণ: সৌদি আরবে ক্লাউড সিডিং মরুকরণ মোকাবিলায় সহায়ক।

৩. পরিবেশবান্ধব

  • রাসায়নিক বর্জ্য কমায়, যদি পরিবেশবান্ধব বীজ ব্যবহার হয়।
  • উদাহরণ: সল্ট-ভিত্তিক সিডিং পরিবেশবান্ধব।

৪. অর্থনৈতিক সুবিধা

  • কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
  • উদাহরণ: আইডাহোতে ক্লাউড সিডিং কৃষি লাভ বাড়ায়।

৫. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা

  • খরা এবং বন্যার অসমতুল্যতা কমায়।
  • উদাহরণ: টেক্সাসে ফ্লাড মোকাবিলায় ক্লাউড সিডিং।

কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ

১. কার্যকারিতার অনিশ্চয়তা

  • বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির হার ৫-১৫% পর্যন্ত, কিন্তু সবসময় সফল হয় না।
  • উদাহরণ: GAO রিপোর্টে কার্যকারিতা যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ।

২. পরিবেশগত উদ্বেগ

  • সিলভার আয়োডাইডের ব্যবহার মাটি এবং পানিতে দূষণ ঘটাতে পারে।
  • উদাহরণ: পরিবেশবান্ধব বিকল্প যেমন সল্ট ব্যবহারের দাবি।

৩. উচ্চ খরচ

  • বিমান এবং বীজের খরচ ব্যয়বহুল।
  • উদাহরণ: একটি ক্লাউড সিডিং মিশনের খরচ ১০-২০ লাখ টাকা।

৪. আইনি এবং নৈতিক সমস্যা

  • আবহাওয়া পরিবর্তনের নৈতিকতা এবং আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের অভাব।
  • উদাহরণ: ২০২৫ সালে US-এর ৫টি ওয়েদার মডিফিকেশন প্রকল্প।

৫. প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা

  • মেঘের গঠন এবং বাতাসের গতির উপর নির্ভরশীল।
  • উদাহরণ: ড্রোন-ভিত্তিক সিডিং ২০২৫ সালে উন্নত হলেও সীমিত।
কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তি ও তার সম্ভাবনা

বাংলাদেশে কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তির সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ক্লাউড সিডিং-এর সম্ভাবনা বিশাল, বিশেষ করে খরা-প্রবণ এলাকায়।

১. বাজারের সম্ভাবনা

  • বাংলাদেশে বার্ষিক ১০০ দিন খরা হয়, যা কৃষিতে ক্ষতি করে।
  • উদাহরণ: BMD-এর ক্লাউড সিডিং পরীক্ষা ১০% বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি করেছে।

২. চলমান উদ্যোগ

  • BMD প্রকল্প: খরা মোকাবিলায় ক্লাউড সিডিং পরীক্ষা।
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ভারত এবং চীনের সাথে যৌথ প্রকল্প।
  • গবেষণা: BUET এবং SPARRSO-এর গবেষণা।

৩. সরকারি নীতি

  • লক্ষ্যমাত্রা: ২০৩০ সালের মধ্যে ক্লাউড সিডিং ব্যাপক প্রয়োগ।
  • নীতি: জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনায় আবহাওয়া পরিবর্তনের উল্লেখ।

৪. অবকাঠামো উন্নয়ন

  • ড্রোন এবং রকেট-ভিত্তিক সিডিং সিস্টেম।
  • উদাহরণ: ২০২৫ সালে ড্রোন-ভিত্তিক পরীক্ষা।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায়

১. আর্থিক সহায়তা

  • আন্তর্জাতিক তহবিল এবং সরকারি ভর্তুকি।
  • উদাহরণ: Green Climate Fund থেকে তহবিল।

২. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন

  • পরিবেশবান্ধব বীজ এবং ড্রোন প্রযুক্তি।
  • উদাহরণ: সল্ট-ভিত্তিক সিডিং।

৩. জনসচেতনতা

  • সামাজিক মাধ্যম এবং কৃষক প্রশিক্ষণ।
  • অনলাইন শিক্ষা:
    • Coursera: Weather Modification Technology – সময়কাল: ৪ সপ্তাহ, মূল্য: $49/মাস।
    • edX: Climate Engineering – সময়কাল: ৬ সপ্তাহ, মূল্য: বিনামূল্যে অডিট।

৪. নীতি প্রণয়ন

  • ক্লাউড সিডিং-এর জন্য কঠোর নিয়মাবলী।
  • উদাহরণ: US-এর ওয়েদার মডিফিকেশন আইন।

৫. গবেষণা

  • BMD এবং BUET-এর যৌথ গবেষণা।
  • উদাহরণ: ২০২৫ সালে ফান্ডিং বৃদ্ধি।

উপসংহার

কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তি বাংলাদেশের জন্য খরা মোকাবিলা এবং কৃষি উন্নয়নের একটি সম্ভাবনাময় সমাধান। এর কার্যকারিতা এবং পরিবেশগত সুবিধা ২০২৫ সালে আরও প্রমাণিত হয়েছে। তবে, পরিবেশগত উদ্বেগ এবং খরচের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিক নীতি এবং গবেষণা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এই প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।


আপনার মতামত: বাংলাদেশে কৃত্রিম বৃষ্টির প্রযুক্তির প্রসারে কোন ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত? আপনার মূল্যবান মতামত শেয়ার করুন!

মন্তব্যসমূহ
* ইমেইলটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে না।